সোমনাথ পাল , বনগাঁ: “এ কেমন স্বাধীনতা? এক ঘোষণায় বন্ধুকে কেড়ে নিল?” এই দিনটি এলেই বনগাঁর অনেকে আবেগে ভাসেন। রেডিওতে এক লাইনের বার্তা। আর তার ফলেই ভাগ হল দেশ, মাটি, মাঠের খেলা, স্কুলের শাসন, ছেলেবেলার ছোট চোট আনন্দের মুহূর্তগুলো। শৈশবের খেলার সঙ্গী চলে গেল ওপার বাংলায়। বিচ্ছেদের বেদনা নিয়ে ১৯৪৭-র ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় স্বাধীনতা স্বাদ পেল ভারতবর্ষ। দীর্ঘ দু’শো বছরের বৃটিশ শাসনের পরাধীনতার গ্লানি স্বাধীন হল গোটা দেশ আসমুদ্রহিমাচল যখন স্বাধীনতার আনন্দে মাতোয়ারা তখনও দুঃখের প্রহর গুনছে বনগাঁ। বর্তমানে ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত শহর।
দেশ স্বাধীন হলেও বনগাঁ তখনও পরাধীন। এক রাতের মধ্যে দুই বাংলার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। মাঝে পড়ে যায় সীমান্ত শহর বনগাঁ। কেননা প্রশাসকরা তখনও দোলাচালে, কোনদিকে যাবে বনগাঁ। ভাগ যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানে নাকি ভারেতর পশ্চিমবঙ্গে? বনগাঁর ভাগ্য নির্ধারণ করতে কেটে গেল দু’দিন। ১৭ আগষ্ট সন্ধ্যায় রেডিও মারফৎ ঘোষণা হল, বনগাঁ থাকবে পশ্চিমবঙ্গেই। এই বার্তার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশের শৃঙ্খল থেকে বনগাঁর মুক্তি মিলল। ১৮ আগস্ট সকালে বনগাঁ আদালতে উড়ল স্বাধীন ভারতের পতাকা। স্থানীয় বাসিন্দা মনোজ রায়ের বাড়ির রেডিওতে ঘোষণা শোনা মাত্রই চোখের জলে ভেসেছিলেন রতনবাবু। কে জানত পরবর্তীতে তিনিই হবেন বনগাঁ মহকুমা আদালতের বর্ষীয়ান আইনজীবী রতনময় ঘোষ।
এক লাইনের রেডিও বার্তাই সেদিন রতনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল বন্ধু গোলাম মোস্তাফাকে। সেদিন ছোট্ট রতনের প্রিয়বন্ধু মোস্তাফার পরিবার বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে ওপার বাংলায় চলে যায়। কাঁটাতার বন্ধু বিচ্ছেদ ঘটালেও গোলামের কথা ভুলতে পারেননি রতনবাবু। বনগাঁরা স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে যেন জড়িয়ে গিয়েছে রতনের প্রিয়জন বিচ্ছেদের ব্যথা। ১৮ আগস্ট এখনও ধুমধামের সঙ্গে বনগাঁ আদালত চত্বরে পতাকা ওড়ে। এই সেদিনও যশোর জেলার অন্তর্গত মহাকুমা শহর ছিল বনগাঁ। একসময় যে বনগাঁ ছিল নদিয়া জেলার অন্তর্গত। সেই সময় বারাসাত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাশলে ইডেন ও নদিয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার হর্শেল নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে কৃষকদের কথা মাথায় রেখে বনগাঁকে আলাদা মহাকুমার রূপ দেন। তখন থেকেই দুই বঙ্গের জংশন বনগাঁ প্রশাসনিক কর্মদক্ষতায় ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়। আজ সেসব ইতিহাস। তবুও প্রতিবছর পাতা উলটে সেই দিনটিতে ফিরে যায় বনগাঁ শহর। আজও ইতিহাসের স্মৃতি আঁকড়ে আদালত চত্বরে ১৮ আগস্ট সকালে ওড়ে জাতীয় পতাকা। আইনজীবীরা তেরঙ্গা উত্তোলন করে ফেল আসা দিনটির উদযাপনে মাতেন। সারাদিন ধরে শহিদবেদীতে মাল্যদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা চলে। এবছরও এনিয়মের হেরফের হয়নি। শনিবার একেবারে নিয়ম করে চলল স্বাধীনতার আস্বাদ গ্রহণের পালা। এদিন বনগাঁ আদালতের আইনজীবী সংগঠনের সম্পাদক সমীর দাসের নেতৃত্বে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.