সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ধান গোলায় উঠলে প্রতিবার ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলতেন যে বৃদ্ধ, তার কাছে প্রশ্ন করত ছেলে-ছোকরারা। কাঁদো কেন? বৃদ্ধ চোখের জল মুছে বলতেন, কী জানি পরের বার আর দেখতে পাব কি না! আহা বড় মায়া! কত মায়া যে লুকিয়ে থাকে ফসলের আবডালে! মায়াবি সে উচ্ছ্বাস কিংবা বিষণ্ণতার কী রং হয় কে জানে! তবে ক্যালেন্ডারে এসব দিনে লাল দাগ থাকে না। যেমন থাকল না গতকালও। অথচ সমস্ত ফুটবলপ্রেমী দিনটাকে নিশ্চিতই মনের পঞ্জিকায় আলাদা করে দাগ দিয়ে রেখে দেবেন। কারণ এরকম বিরল দিনেই মাঠে কেউ হয়ে ওঠেন ঈশ্বরপ্রতীম। আর গ্যালারিতে বসে তখন উচ্ছ্বাসে মগ্ন হন ফুটবলের ভগবান।
দিয়েগো মারাদোনা। নামটুকুই যথেষ্ট। ফুটবল বিশ্ব নতজানু ঈশ্বরের এই সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টির কাছে। কত বিতর্ক, কত শিরোনাম। তবু মায়া। তবু ছিয়াশির সেই একক ক্ষমতার সোনার জলে লেখা প্রদর্শন। মারাদোনা তো তাই শুধু একজন খেলোয়াড় নন। তিনি যুগের উন্মাদনা। কারও ফেলে আসা কৈশোরের বেহিসেবী হওয়ার ভরসা। কারওবা যৌবনের ছক ভাঙার দুঃসাহস। একা একজন বিশ্ব হয়ে ওঠা আর ক’জনই বা পারেন! ক’জনই বা পেরেছেন? প্রতিভা-দক্ষতার তুল্যমূল্য হিসেব খাতায়-কলমে কষে যায়। কিন্তু ওই যে আবেগের কোনও ব্যালান্স সিট হয় না। মারাদোনা প্রতিবার সেখানেই জিতে যান। যেমন জিতে গেলেন নাইজেরিয়া ম্যাচের দিনেও।
Maradona reacting to Messi’s goal.pic.twitter.com/Be0vEoJKQG
— BarcaUniversal Comps (@BarcaRaw) June 27, 2018
সত্যিই এমন দিন দেখার সৌভাগ্য কচ্চিত হয়। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার খাঁড়া ঝুলছে মাঠের উপর। এমতাবস্থায় মাঠে নেমেছেন মেসি। যিনি নিজেও এই প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীর কাছে ঈশ্বরই। একদিকে মাঠ মাতাচ্ছেন ঈশ্বর, অন্যদিকে গ্যালারি মাতাচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের কাছে এ যেন ইন্দ্রজালের জোড়া শো। আর দর্শকদের কাছেই অবশ্য ফুটবল রোমান্সের যৌথখামার। দুঃসহ চাপের মুখে যখন মেসির স্বপ্নের দৌড় নয়া রূপকথার জন্ম দিচ্ছে, তখন ভিভিআইপি আসনে সটান উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। আবেগের সাতরং তখন খেলা করছে চতুর্দিকে। জড়িয়ে ধরছেন পাশে বসে থাকা বন্ধুকে। কে বলবে তিনি মাঠে নেই! শুধু কি একা মেসিই খেলছেন? আর্জেন্টিনার সমর্থকরা নিশ্চয়ই বলবেন, মাঠের বাইরে বসে খেলছিলেন যেন মারাদোনাও। আর তাঁর সঙ্গেই খেলছিল দুরন্ত ছিয়াশি কিংবা নব্বই। মেসির হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছে হাল আমল। দুই প্রজন্ম তখন মুখোমুখি।
[ মেসি ম্যাজিকে শাপমোচন আর্জেন্টিনার, জায়গা পাকা শেষ ষোলোয় ]
একসময় তো মধ্যমাও দেখালেন ফুটবলের ভগবান। কাকে দেখালেন? মনে হতে পারে সমালোচকদের। অথবা স্বয়ং ঈশ্বরকে। যে ঈশ্বর যন্ত্রণার অন্ধকূপে নিমজ্জিত করেন, যে ঈশ্বর চোখের জল ভালবাসে, তাঁকেই হয়তো জানালেন, কেউ কেউ ঈশ্বরকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। পেরেছিলেন তিনি নিজে। তাঁর বিশ্বাস, মেসিও পারবেন। অবশ্য এ নিয়ে বিতর্কও হচ্ছে, তবে বিতর্ককে তিনি আর কবেইবা পরোয়া করেছেন!
wait wait wait is Maradona wearing two watches?? pic.twitter.com/0tTNF3Pw7O
— maurice (@tallmaurice) June 27, 2018
অবশ্য, দিনটা ভাল গেল না। খেলা দেখতে দেখতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। চোখ যখন বন্ধ তখন ক্যামেরা তাঁকে আচমকা দেখতে পেল। অনেক কষ্টে চোখ খুললেন দিয়েগো। পরে দেখা গেল, দু’জন চিকিৎসক দেখছেনও তাঁকে। আনন্দে-উত্তেজনায় কিংবা অন্য কারণে নাইজেরিয়া ম্যাচের শেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন মারাদোনা। তাঁকে পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।
তবু এদিন মারাদোনা যা দেখিয়ে দিলেন তা গোটা ফুটবল বিশ্ব নিঃসন্দেহে মনে রাখবে। আবেগের বাড়াবাড়ি মেলোড্রামা ডেকে আনে। কিন্তু তিনি যে তাঁর মারাদোনা। তিনি নিজেই আস্ত পৃথিবী। সেখানকার নিয়মকানুন, সংজ্ঞা সবই আলাদা। মাঠের বাইরে যে উন্মাদনার তুফান তুললেন তিনি, তা অভূতপূর্ব। যেন আজও জয়ের খিদে বুকে নিয়ে ঘুরে ফিরছেন। যেন আর্জেন্টিনার জয় তাঁর নিজের জয়। কখনও লাফালেন। কখনও ঝাঁপালেন। কখনও দু-হাত মেলে দিলেন।
এখনও এত উচ্ছ্বাস। এত উন্মাদনা। এত প্রেম। কে বলবে, তাঁর রূপকথা সেই কবেকার পুরনো? বরং এই মারাদোনা যেন নতুন করে বলতে এসেছেন, ছিয়াশি কখনও বুড়ো হয় নাকি!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.