Advertisement
Advertisement

Breaking News

প্রতিমায় মায়ের মুখ লুকিয়ে এখানে চলে উনিশ দিনের দুর্গোৎসব

৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজও রাজা জগৎ মল্লের তৈরি দুর্গা মন্দিরে প্রতি বছর একই মূর্তিতে মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপুজো হয়ে চলেছে৷

Bishnupur's Mrinmoyee: The Hidden Secret Behind Durga Puja
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:August 13, 2016 3:00 pm
  • Updated:June 12, 2018 4:13 pm

ইন্দ্রজিৎ দাস: ৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ বাংলার ১০১ বঙ্গাব্দে আজকের বাঁকুড়া জেলার প্রদ্যুম্নপুরে রাজা রঘুনাথ মল্ল, মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন৷ মল্ল কথাটির অর্থ বাহু যু‌দ্ধে নিপুণ ব্যক্তি৷ মল্লশাসিত রাজ্যটির নতুন নামকরণ হল– মল্লভূম৷ রঘুনাথের রাজ্যাভিষেকের কালটিকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে সূচনা হল নতুন এক অব্দের, রাজা রঘুনাথের পদবি অনুসারে তার নাম হল ‘মল্লাব্দ’৷ অর্থাত্‍ মল্লাব্দ ‘এক’-এ শুরু হল মল্লরাজাদের রাজত্বকাল৷ মল্ল বংশের আদিপুরুষ হিসাবে রঘুনাথ ‘আদিমল্ল’ নামে পরিচিত হলেন৷
৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে মল্ল বংশের ১৯তম রাজা জগৎ মল্ল মল্লভূমের রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করলেন৷ ঈশ্বরবিশ্বাসী রাজা জগৎ মল্ল এক দৈববাণী অনুসারে মাটি খুঁড়ে পেলেন এক দেবীমূর্তির মুখমণ্ডল৷ দেবীর ইচ্ছানুসারে ওই মুখমণ্ডলটি মাটির প্রতিমার অন্তরালে ঢাকা রেখে গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি করালেন এক দুর্গামূর্তি৷ দেবীর নাম হল মৃণ্ময়ী৷

mrinmoyee6_web
দেবী মৃণ্ময়ী

৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বা ৪০৪ বঙ্গাব্দে, ৩০৩ মল্লাব্দে রাজা জগত্‍ মল্ল বিষ্ণুপুরে মন্দির তৈরি করে মা মৃণ্ময়ীর মূর্তি স্থাপন করলেন৷ মা মৃণ্ময়ী হলেন মল্ল রাজপরিবারের কুলদেবী। তিনিই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা৷ এভাবে শুরু হল মল্ল রাজপরিবারের দুর্গাপুজো৷
সেই থেকে আজও রাজা জগৎ মল্লের তৈরি দুর্গা মন্দিরে প্রতি বছর একই মূর্তিতে মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপুজো হয়ে চলেছে৷ মায়ের স্বপ্নাদেশে দেবী মূর্তির অঙ্গরাগ হয়। অর্থাৎ যে বছর মা স্বপ্নাদেশ দেন, সেই বছরে মৃণ্ময়ী দেবীর মূর্তিকে নতুন করে রং করা হয়৷ মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপুজো হয় আঠারো-উনিশ দিন ধরে৷ জিতাষ্টমীর দিনে জীমূতবাহন পুজোর পবিত্রলগ্ন থেকে সূচনা হয় রাজবাড়ির দুর্গাপুজো৷ পরদিন কৃষ্ণানবমী তিথিতে দেবীর কল্পারম্ভ৷ ওইদিন মায়ের বেলবরণ অনুষ্ঠান হয়৷

Advertisement
mrinmoyee1_web
বড় ঠাকুরানি

এখানে মা মৃন্ময়ী দেবীর সঙ্গে পটে আঁকা আরও তিনটি দুর্গারও পুজো হয়৷ এঁরা হলেন বড় ঠাকুরানি, মেজো ঠাকুরানি ও ছোট ঠাকুরানি৷ তিনটি পট একইরকম দেখতে হলেও বড় ঠাকুরানি লক্ষ্মীবিলাস শাড়ি পরিহিতা, মেজো ঠাকুরানির শাড়ি লাল রঙের এবং ছোট ঠাকুরানির শাড়ির রং কমলা৷ বংশপরম্পরায় ফৌজদার পরিবার এই পটগুলো অঙ্কন করেন৷ জিতাষ্টমীর পরের দিন অর্থাত্‍ কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে কৃষ্ণবাঁধে স্নান করিয়ে বড় ঠাকুরানির আগমন হয় দুর্গামন্দিরে৷ ওইদিনই মৃন্ময়ী দেবীর মন্দিরে নবপত্রিকার পুজো করা হয়৷

Advertisement
mrinmoyee2_web
মেজো ঠাকুরানি

শারদীয়া চতুর্থীর দিন মেজো ঠাকুরানির পট দুর্গামন্দিরে নিয়ে আসা হয়৷ দেবীপক্ষের ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যার পর রাজপুরোহিত শোভাযাত্রা সহকারে ছোট ঠাকুরানির পট শ্যামকুণ্ডে নিয়ে যান৷ সেখান থেকে বোধনস্থল বিল্ববৃক্ষতলায় পুজো করে ছোট ঠাকুরানির পট দুর্গামন্দিরে স্থাপন করা হয়৷

mrinmoyee3_web
ছোট ঠাকুরানি

মহাষ্টমীর দিন সকালে মল্লরাজবাড়ির অন্দরমহলে অবস্থিতা বিশালাক্ষী দেবীর মূর্তিকে দুর্গামন্দিরে নিয়ে এসে মেজ ঠাকুরানির সামনে একটি রুপোর থালার ওপর রাখা হয়৷ মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে কামানে তোপ দেগে সন্ধিক্ষণের পুজো শুরু হয়৷ মহাদণ্ড উপাধিধারীরা বংশানুক্রমে আজও মল্লরাজবংশের কামান দাগেন৷ রাজবাড়ির তোপধ্বনির শব্দ কানে এলে তবেই সারা বিষ্ণুপুর শহরের সব পুজোমণ্ডপে শুরু হয় মা দুর্গার সন্ধিক্ষণের পুজো, সঙ্গে ফাটতে থাকে পটকা৷

mrinmoyee5_web
সন্ধিপূজার কামান

মহানবমীর নিশিরাতে দুর্গামন্দিরে মহামারীর অধিষ্ঠাত্রী ‘খচ্চরবাহিনী’ দেবীর পুজো হয়৷ দেবীর মূর্তি পটে আঁকা, রাজবাড়ির অন্তঃপুরে গোপনে রাখা থাকে৷ অনেক বছর আগের আঁকা এই পটে কী রূপ আছে, খুলেও দেখা হয় না৷ নবমীর গভীর রাতে রাজবাড়ি থেকে দুর্গা মন্দিরে এনে তাঁকে পুজো করা হয়৷ রাজপুরোহিত পটের দিকে পিছন ফিরে বসে বাঁ-হাতে পুজো করেন৷ শুধুমাত্র রাজা ও রাজপুরোহিত ছাড়া মন্দিরে আর কেউ থাকেন না৷ জনশ্রুতি আছে, যে পুরোহিত এই পুজো করেন তিনি নির্বংশ হন৷ পুজো শেষ হলে ওই রাতেই পটটিকে রাজবাড়ির অন্দরমহলের গোপনকক্ষে গিয়ে রেখে আসা হয়৷
বিজয়া দশমীর সকালে নবপত্রিকাকে গোপালসায়রে বিসর্জন দেওয়া হয়৷ দেবীমূর্তি বা কোনও পট বিসর্জন হয় না৷ নবপত্রিকাতে থাকা ধান ও মান গাছকে খুলে রেখে বিসর্জন দেওয়া হয়৷

mrinmoyee4_web
মৃণ্ময়ী মন্দির প্রাঙ্গন

এরপর দশমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত তিনদিন ধরে চলে রাবণ কাটা উৎসব৷ হনুমান, সুগ্রীব, জাম্বুবান আর বিভীষণের মুখোশ ও লোমের পোশাক পরে চারজন মানুষ সারাদিন ধরে নেচে নেচে ঘোরেন সারা বিষ্ণুপুর শহর৷ সঙ্গে থাকেন বাজনদার৷ দশমীর দিন রঘুনাথ জিউয়ের মন্দিরে রাম, লক্ষ্মণ, সীতার পুজোর পর মুখোশ নাচের অভিষেক হয়৷ দশমীতে কুম্ভকর্ণ বধ উৎসব, একাদশীতে ইন্দ্রজিৎ বধ উৎসব এবং সবশেষে দ্বাদশীর রাতে হয় রাবণ বধ উৎসব৷ এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে জিতাষ্টমীতে শুরু হওয়া মল্লরাজবাড়ির উনিশ দিনের দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটে৷
কীভাবে এই পুজো দেখতে যাবেন:
সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস, শালিমার থেকে আরণ্যক এক্সপ্রেস অথবা হাওড়া থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে চলুন বিষ্ণুপুর৷ সেখান থেকে দেখতে হবে মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপুজো৷ একাধিক হোটেল রয়েছে বিষ্ণুপুরে৷ দুর্গাপুজোয় বিষ্ণুপুর গিয়ে দ্বাদশী অবধি থাকলে রাবণ কাটা উৎসবও দেখা যাবে৷

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ