ছাত্র আন্দোলনের জেরে গদিচ্যুত শেখ হাসিনা। ছেড়েছেন দেশ। বাংলাদেশে ফের সেনাশাসন! তবে কি ফিরবে এরশাদ জমানা? যার হাত ধরে স্বাধীনতা পেয়েছিল, বাংলাদেশে ভাঙা হল সেই মুজিবর রহমানের মূর্তিও। লুটপাট চলল গণভবনে। গোটা পরিস্থিতিটা কীভাবে দেখছেন ছাত্র আন্দোলনকারীরা? বাংলাদেশ থেকে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইন-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবু হেনা মারুফ ইমরান। শুনলেন মণিশংকর চৌধুরী।
কোটা বাতিলের দাবিতে পথে নেমেছিল ছাত্ররা। আদালতের রায়ে কোটা বাতিলের পর থেমেও গিয়েছিল আন্দোলন। নতুন করে কেন উত্তাল হল বাংলাদেশ?
এটা মানুষের রাগ। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। শুরুর দিকে সাধারণ মানুষ সেই অর্থে রাস্তায় নামেনি। তবে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের উপর পুলিশি দমন-পীড়ন এবং শাসকদলের অত্যাচার মানুষ মেনে নিতে পারেনি। এটা পুলিশের গুলির সামনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। এটা ছাত্র লিগের বিরুদ্ধেও জনতার রোষ। কোটার সঙ্গে সাধারণ মানুষের তেমন যোগ ছিল না। তবে সাধারণ ছাত্রদের উপর ছাত্র লিগ ও পুলিশের হামলাই আগুন উসকে দেয়। হাসিনা পালালেন. আমরা ভেবেছিলাম সেটাই করবে। সহিংসতা ছিল না, ভাঙচুর ছিল না শুরুতে। হঠাৎ করে আগুন জ্বলে উঠে। এই ব্যাপারগুলোর সঙ্গে কিছু দেশীয় জঙ্গি সংগঠনের হাত। সেই অর্থে বিদেশি শক্তির হাত নেই বলেই আমার ধারনা।
হিংসার নেপথ্যে কি বিএনপি-জামাত?
এক্ষেত্রে আমাদের একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। এর আগে তারা দেশও শাসন করেছে। কিন্তু জামাত বা জামাত-ই-ইসলামি এক ধর্মভিত্তিক দল। এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। জামাতকে মানুষ পছন্দ করে না। এরা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ায়। কিন্তু খালেদা জিয়ার দল বিএনপির প্রতি মানুষের আশা ছিল। গণতন্ত্রে সবসময় বিরোধী শক্তির দরকার। শুরুতে বিএনপি নিজের ভূমিকা পালন করে। তবে পরের দিকে তারা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। বিএনপি কিছুই করতে পারেনি। আমরা আশাহত। হাসিনা সরকারের এই পতন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপির হাতে হওয়া উচিত ছিল। তাই বিএনপি-জামাতকে এক সারিতে ফেলা ভুল। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি সুষ্ঠু সরকার গঠন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
কাকে মসনদে দেখতে চায় বাংলাদেশের মানুষ?
আমার মতে এই মুহূর্তে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনিসকে চাইছে মানুষ। দেশে যে রাজনৈতিক ভাঙন ধরেছে, অর্থনীতির যে বেহাল অবস্থা তা আশা করি উনি ঠিক করতে পারবেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গড়তে চলেছে সেনা, তবে ফৌজ কি ক্ষমতা ছাড়বে?
আজকের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা দেখেছি, সেনাশাসক এরশাদকে সরাতে তিন বছর সময় লেগেছিল। ফলে আমাদের মধ্যে কিছুটা ভয় তৈরি হয়েছে। সুনিশ্চিতভাবে এখনই কিছু বলতে পারছি না। কয়েকটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা হয়েছে। তবে তা দেশের সার্বিক চিত্র নয়। আমার বাড়ি সাতক্ষীরা। সেখানে কোনও দিন সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখিনি। হিন্দু-মুসলিম সংঘাত দেখিনি। কেউ বা করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিংসা ছড়ায়। গতকাল রাতে সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলিগের একটি কথোপকথন আমাদের কাছে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, উপাসনালয়ে আগুন দিতে হবে। উত্তেজনা তৈরি করতে হবে। ফলে এটা একটা বড় ষড়ষন্ত্র বলে আমার ধারনা।
সেনা ক্ষমতা না ছাড়লে ফের কি পথে নামবে পড়ুয়ারা?
অবশ্যই নামবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যায় অবিচার এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি দাবি করলে এবারও রুখে দাঁড়াবে। আমাদের কোনও সরকার দমাতে পারেনি। সেনা যদি ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গদি না ছাড়ে বা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না ফেরায়, তাহলে আমরা আবার পথে নামব। আবারও হবে বৃহত্তর আন্দোলন।
সংখ্যালঘুদের উপর কি আক্রমণের খাঁড়া ঝুলছে?
এখানে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। সাম্প্রদায়িক শক্তির পাশাপাশি এই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। হিন্দুদের উপর আঘাত তাদেরই ষড়যন্ত্রের অংশ। আরও একটা বিষয়। এতোদিন সরকারের মদতপুষ্ট বা আওয়ামি লিগের নেতা-মন্ত্রীরা যথেচ্ছ অত্যাচার চালিয়েছে। লিগে হিন্দুও আছে, মুসলমানও আছে। আজ আওয়ামি সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু মানুষের ক্ষত সারেনি। সেই জনরোষে আওয়ামিদের উপর আঘাত আসবেই। এক্ষেত্রে মুসলিম আওয়ামি নেতা আক্রান্ত হলে তা শিরোনামে জায়গা পাবে না, কিন্তু হিন্দু নেতা আক্রান্ত হলে তা প্রচারে আসবে। এখানে ধর্মীয় পরিচয় নয়, রাজনৈতিক পরিচয়ই হামলার কারণ।
আপনি কি সাতক্ষীরায়? সেখানকার অবস্থা কেমন?
এই মুহূর্তে দেশে আইনশৃঙ্খলা নেই বললেই চলে। তবে এটা হওয়ারই ছিল। যুদ্ধকালীন বা রাজনৈতিক ডামাডোলে এমনটা হয়েই থাকে। সহজ কথায় বললে, এখন দেশ গড়ার কাজ চলছে তাই বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। কিন্তু ফের হাল ফেরাতে হবে। আমরা সেই সময়ের অপেক্ষা করছি। ৭১-এর কথা মনে আছে। তখনের মতো অরাজকতা হয়েছে। তবে তা সাময়িক।
মুজিবের মূর্তি ভাঙাকে সমর্থন করেন?
একেবারেই সমর্থন করি না। এটা আমাদের ইতিহাসের ধারা। এতে ইতিহাসের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করা যায় না। তবে শুধু যে মুজিবের মূর্তি ভাঙা হয়েছে, তা তো নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছেছে। আরও অনেক ভাস্কর্য ভেঙেছে।
বাংলাদেশে এতো ভারত বিদ্বেষ কেন?
এটা শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা কূটনৈতিক বিদ্বেষ। এই সরকার দিল্লি দ্বারা প্রভাবিত। অন্তত মানুষ তাই মনে করে। গত সাধারণ নির্বাচনে ভিনদেশি মদতে ভোট লুট করা হয়েছে। ভারতের প্রতি অধিকাংশ মানুষের সেই অর্থে কোনও বিদ্বেষ নেই। অনেকেরই রাগ রয়েছে হাসিনা এবং মোদি সরকারের প্রতি। তবে আশা করছি, পরিস্থিতি শান্ত হবে। অবস্থার উন্নতি হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.