Advertisement
Advertisement

Breaking News

সংগ্রামপুরের কালীমন্দির

স্বপ্নাদেশ পেয়ে কালীমন্দির তৈরি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের, অটুট ৬০০ বছরের ঐতিহ্য

দেবীমূর্তি দক্ষিণা কালীর আদলে, আজও হয় পাঁঠা বলি।

600 years old Kali Temple and Puja of its idol is still attraction to the local people
Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:October 20, 2019 8:24 pm
  • Updated:October 20, 2019 8:28 pm

নবেন্দু ঘোষ, বসিরহাট: ছ’শো বছরের পুরনো ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আড়ম্বর। বসিরহাটের সংগ্রামপুরের কালীমন্দির মানেই তার সঙ্গে যুক্ত এইসব, এখনও। এখানে আজও অটুট পাঁঠা বলির প্রথা। এই মন্দিরের এক কিলোমিটারের মধ্যে অন্য কোনও কালীপুজো হয় না। এটাই প্রথা যা এই মন্দির স্থাপিত হবার পর থেকে চলে আসছে।

“মা এখানে দক্ষিণা কালী রূপে পূজিত হন। খুব জাগ্রত আমাদের মা, দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের পরই আমাদের এই কালী মন্দিরের স্থান। তাই তো হাজার হাজার ভক্ত আসেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে”, এমনই বললেন মন্দিরের সেবায়েত পঙ্গরানি চক্রবর্তী।এই মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে জানা গেল মন্দিরের পূজারি মধুসূদন চক্রবর্তী কাছ থেকে। তিনি বলেন, “রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দে স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির নির্মাণের জন্য জায়গা দান করেন। এরপর কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং গ্রামবাসীদের উদ্যোগে এই কালী মন্দির স্থাপিত হয়। তবে আজ যে রূপ মন্দিরের, তেমনটা আগে ছিল না। শুরুতে ছিল একটা খড়ের চাল দেওয়া মন্দির। তারপর ভক্তদের দানে ও মন্দিরের উন্নয়ন কমিটির সৌজন্যে আজ এমন রূপ পেয়েছে মন্দির। এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দে তিনি মন্দির স্থাপিত করার পাশাপাশি এই মন্দিরে পুজো করার জন্য বর্তমান পূজারি মধুসূদন চক্রবর্তীর পূর্বপুরুষদের গঙ্গার তীরবর্তী একটা স্থান থেকে রাজা নিয়ে আসেন এই সংগ্রামপুরে বসবাসের জন্য।”

Advertisement

[আরও পড়ুন: আগামী বছর রেড রোডের কার্নিভালে অংশ নেবে UNESCO, ঘোষণা মমতার]

সেই থেকেই এই চক্রবর্তী পরিবারের বিভিন্ন সদস্যই এখানে পুজো করে চলেছেন দশকের পর দশক ধরে। এখন এই চক্রবর্তী পরিবারের ৮ জন শরিক। একেক জন ৯ দিন করে পুজো করেন এই মন্দিরে। অর্থাৎ পূজারিরা প্রত্যেকেই একই পরিবারের একই গোত্রের। যেমন, মানিক চক্রবর্তী, সদানন্দ চক্রবর্তী, শিবু চক্রবর্তী সকলেই পালা করে পুজো করেন। কিন্তু এই চক্রবর্তী পরিবার ছাড়াও এখানে আরও ব্রাহ্মণ পরিবার আছে, যাঁদের এই মন্দিরে পুজো করতে দেওয়া হয় না। সেই কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সময় থেকে এটাই প্রথা।
কথিত আছে, এই মন্দিরে মা কালীর সামনে রাখা ঘটটি সংগ্রামপুরের জনৈক এক ব্যক্তির হাতে আসে।আর এই ঘটকে অবলম্বন করেই এই মন্দির গড়ে ওঠে। মন্দিরে মায়ের যে মূর্তিটা রয়েছে, তা কী দিয়ে তৈরি, কেউ জানেন না এখনও। এমনকী কে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন, তাও এই মন্দিরের প্রবীণ পূজারিদের কাছে অজানা। এক পূজারির থেকে জানা গেল, মা এখানে দক্ষিণা কালী রূপে বিরাজমান। মন্দিরে নিত্য পুজো তো চলেই, এবং ভোগও থাকে মায়ের জন্য প্রতিদিন। কালীকে একেক দিন একেক রকম ভোগ নিবেদন করা হয়। যেমন লুচি, চিঁড়ে, ফল, খিচুড়ি,পায়েস ইত্যাদি। এমনকী আমিষ ভোগও দেওয়া হয় কোনও কোনও দিন। এবং যদি কোনওদিন পাঁঠা বলি দেন, তবে সেদিন মাকে বলির কাঁচা মাংস নিবেদন করা হয়।
জানা গেল, এই মন্দিরে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুজো হয়। ভাদ্র মাসে হয় ভদ্রা কালি পুজো,শ্যামা পুজোর রাতে হয় শ্যামা কালি, চৈত্র মাসে গামাটি পুজো ও শীতলা পুজো। এছাড়া এখানে পয়লা জানুয়ারি কল্পতরু উৎসব বা চৈত্র মাসে চড়ক পুজোও হয়। সবমিলিয়ে, সারা বছর জমজমাট থাকে সংগ্রামপুরের এই কালী মন্দির। এখানে শ্যামা পুজোর দিন কিছু বিশেষ রীতি বা প্রথা রয়েছে, যা চলে আসছে প্রায় ৬০০ বছর ধরে। যেমন, এই মন্দিরে প্রত্যেক বছর শ্যামা পুজোর আগে নতুন করে মায়ের মূর্তিতে রং করা হয়। তবে এত পুরনো হওয়া সত্ত্বেও মূর্তির কোনও সংস্কারের প্রয়োজন হয় না। শুধু শ্যামা পুজোর আগে রং হয় বলে মূর্তির আকৃতিতে সামান্য পরিবর্তন এসেছে।

Advertisement

basirhat-kali-mandir

শ্যামা পুজোর দিন প্রত্যেকবার মায়ের চক্ষুদান করার প্রথা আছে এখানে। চক্ষুদান করা হয় সকাল ৮টার মধ্যে। শিল্পী এসে মায়ের চোখ আঁকেন, তারপর ব্রাহ্মণরা দৃষ্টি দান করেন। এবং প্রতিদিন মা যেমন নতুন শাড়ি পরেন। পুজোর দিন মা ভক্তদের দেওয়া বেনারসি শাড়ি পরেন প্রতিবার। সেই সঙ্গে মায়ের গায়ে থাকে বিভিন্ন সোনার অলঙ্কার যেমন হার, মুকুট,চুরি, নথ, কানের দুল-সহ বিভিন্ন গয়না। দুপুরে যেমন নিত্য পুজো হয়, তেমনই হয় শ্যামা পুজোর দিনও। এরপর প্রত্যেক দিনের মত সন্ধেবেলায় শুরু হয় ঘন্টা-কাঁসর সহযোগে সন্ধে আরতি, যা খুব প্রিয় ভক্তদের কাছে। এরপর রাত ১০টা নাগাদ বিশেষ পুজো শুরু হয় অমাবস্যা দেখে, চলে সারারাত ধরে। তৃতীয় প্রহরে পুজোর পর চতুর্থ প্রহরে অর্থাৎ ভোরের দিকে হয় বলি। তারপর আরতি ও পুষ্পাঞ্জলি হয়। কিন্তু এখানে পুজো উপলক্ষে হোম হয় না। কারণটা জানালেন পূজারি মধুসুদন চক্রবর্তী। তিনি বললেন, “শাস্ত্রমতে, হোম করলে ঠাকুরের বিসর্জন, যেহেতু প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের বিসর্জন বলে কিছু থাকতে পারে না তাই এখানে হোম হয় না।”
শ্যামা পুজোর দিন দেবীর ভোগে থাকে মটরের ডাল দিয়ে এঁচোড়ের তরকারি, কচুরমুখী ও চিংড়ি মাছের তরকারি, সঙ্গে সাদা ভাত। এছাড়া মায়ের কাছে নিবেদন করা হয়, পাঁঠা বলির কাঁচা মাংস। জানা গেল, এই ভোগের তালিকার কোনও পরিবর্তন হয়নি আজ পর্যন্ত। এই সময় এঁচোড় পাওয়ার কথা নয়, তবুও প্রত্যেকবার কোনও না কোনও ভক্ত ঠিক নিয়ে চলে আসেন এঁচোড়। এখানে কেন আজও বলি প্রথা চলছে? তার উত্তরে জানা গেল, বলি প্রথাটা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যদি মা ক্ষুব্ধ হন, যদি গ্রামে মড়ক লেগে যায়, তাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আজও চলে কালী পুজোর দিন পাঁঠা বলির প্রথা।

[আরও পড়ুন: বিশ্বের বৃহত্তম স্কাউট সম্মেলন, তরঙ্গের দুনিয়ায় স্বাগত জানাচ্ছে ‘JOTA’]

সংগ্রামপুরের এই কালীমন্দির নিয়ে আরও একটি প্রচলিত গল্প আছে। পাড়ায় কান পাতলে নাকি শোনা যায়, মন্দিরের পিছনে যে পুকুরটি আছে, সেই পুকুরে গভীর রাতে একটা ছোট্ট মেয়ে লাল পেড়ে শাড়ি পড়ে পুকুরে নেমে স্নান করে। আর তাই গ্রামবাসীরা মনে করেন ওই ছোট্ট মেয়েটি আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং মা কালী। আর তাই গ্রামবাসীদের ধারণা, মা তাঁদের মধ্যেই থাকেন। এবং তাঁদের সব ইচ্ছেই পূরণ করেন। কালীপুজোর দিন এত ভক্তসমাগম হয় যে তা সামাল দিতে প্রচুর পুলিশ এখানে মোতায়েন করা হয়। কলকাতা থেকে আসা সুতপা ভট্টাচার্য, শর্মিষ্ঠা ঘোষ, ডলি সরকাররা বললেন, “এই মন্দির খুব জাগ্রত। তাই তো গত ২০ বছর ধরে প্রায় প্রত্যেক মাসে একবার অবশ্যই আসি মায়ের দর্শন পেতে। আমাদের বিশ্বাস, একদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মত এই মন্দিরকেও সবাই চিনবে।”

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ