ব্রতীন দাস, শিলিগুড়ি: খড়গপুর আইআইটি-র হাত ধরে বাংলায় ফিরছে ঢেঁকি। পরম্পরা বজায় রেখে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে কাঠের ঢেঁকিতে যুক্ত হয়েছে যন্ত্র। ফলে এই ঢেঁকিতে আর পা রেখে ধান ভাঙতে হবে না। বিদ্যুতের সংযোগ পেলেই ঢেঁকি চলতে শুরু করবে। এমনকী, ঘণ্টায় কুড়ি থেকে পঁচিশ কেজি পর্যন্ত ধান ভাঙতে পারবে খড়গপুর আইআইটি-র বিশেষজ্ঞদের উদ্ভাবিত এই ঢেঁকি। দাম ২৫ হাজার টাকা।
[তারাপীঠে এবার ভক্তদের জন্য নিষিদ্ধ হচ্ছে স্নান দর্শন]
পুষ্টিগুণ ফেরাতে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খাওয়াতে ইতিমধ্যে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য। জেলায় জেলায় শুরু হয়েছে হারিয়ে যেতে বসা দেশি ও সুগন্ধী ধান ফেরানোর কাজ। সেইসঙ্গে বিশেষ পুষ্টিগুণ রয়েছে, এমন জাতের ধান চাষ শুরু হয়েছে। কৃষি দপ্তরের তরফে দেশি ধানের ক্লাস্টার করা হচ্ছে জেলায় জেলায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সাধারণভাবে যেসব রাইস মিল রয়েছে, সেখানে ধান ভাঙালে চালের গায়ে যে ফাইবারের আস্তরণ থাকে তা উঠে যাচ্ছে। ফলে চাল দেখতে চকচকে হলেও তার মধ্যে থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে পুষ্টি বা ওষধিগুণ। স্বাভাবিকভাবে কালাভাতের মতো প্রচুর অ্যান্থোসায়ানিনযুক্ত ব্ল্যাক রাইস ফলিয়েও সেভাবে সুফল মিলছে না। সেকারণেই পুষ্টিগুণ ধরে রাখতে ঢেঁকি ছাঁটা চাল উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রাজ্যের তরফে। এক্ষেত্রে কৃষির পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে খাদি ও গ্রামীণ শিল্প উন্নয়ন দফতর।
[পথের বাঁকে ইতিহাস, ডালিমগড় চেনেন কি?]
তবে বর্তমানে কাঠের ঢেঁকির সংখ্যা খুবই কম। এক-একটি জেলায় ঘুরে হাতেগোনা কয়েকটি খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। অনেক কষ্টে কাঠের দু’-একটি ঢেঁকি পাওয়া গেলেও তা চালাতে জানেন, এমন মানুষ আবার পাওয়া কঠিন। এই পরিস্থিতির অনেকটাই মুশকিল আসান করে দিয়েছে খড়্গপুর আইআইটি-র তৈরি যন্ত্রচালিত এই ঢেঁকি। ফলে ফার্মার্স ক্লাব থেকে এগ্রি প্রোডিউসার কোম্পানিগুলির মধ্যে ওই ঢেঁকি কিনতে দারুণ উৎসাহ তৈরি হয়েছে।
[‘ভিলেন’ সেই ঘূর্ণাবর্ত, দক্ষিণবঙ্গে কমবে শীতের দাপট]
ইতিমধ্যে রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতরের উদ্যোগে জেলায় জেলায় চলা সুফল বাংলা-র স্টলে ঢেঁকিছাঁটা চাল বিক্রি শুরু হয়েছে। ঢেঁকিছাঁটা চাল উৎপাদনে গোটা রাজ্যে প্রাথমিকভাবে যে ৬১টি গ্রামকে বাছাই করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লক। এক হাজারেরও বেশি কৃষককে নিয়ে তৈরি ছাতনা এগ্রো প্রোডিউসার কোম্পানি ইতিমধ্যে খড়্গপুর আইআইটি-র কাছ থেকে ঢেঁকি কিনেছে। কয়েক দিনের মধ্যে তারা ওই ঢেঁকিতে ধান ভাঙানো শুরু করতে চলেছেন বলে জানিয়েছেন ওই এফপিও-র সিইও তাপস দাস, মার্কেটিং অফিসার সিদ্ধেশ্বর চিনা। ছাতনার সহকারী কৃষি অধিকর্তা অরিন্দম মণ্ডল জানান, “পরম্পরাগত কৃষি যোজনায় এই ব্লকে গোবিন্দভোগ, বাদশাভোগ, কেরালা সুন্দরি, বহুরূপী, ভূতমুড়ি, কেলাসের মতো দেশি ধান চাষ করছি। দলপুর ও চামকরা এলাকায় কৃষকের জমিতে দেশি ধানের ক্লাস্টার তৈরি করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য, ঢেঁকি ছাঁটা চাল উৎপাদন করে জেলার বাইরে মার্কেটিং করা।”
কাঠের সঙ্গে যন্ত্র বসিয়ে ঢেঁকিকে নতুন রূপ দিয়েছেন খড়গপুর আইআইটি-র কৃষি ও ফুড টেকনোলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মাহাতোর নেতৃত্বাধীন টিমের পাঁচ সদস্য। প্রশান্তবাবু বলেন, “২০১৫ সালের শেষের দিকে আমরা ওই ঢেঁকির উদ্ভাবন করি। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান-সহ বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি আমাদের তৈরি ঢেঁকির ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, মহারাষ্ট্রে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বাংলায় বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ফার্মার্স ক্লাব আমাদের ঢেঁকি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।” খড়্গপুর আইআইটি-র কাছ থেকে ঢেঁকি তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাঁকুড়া সম্মিলনী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ঢেঁকির পাশাপাশি খড়গপুর আইআইটি মুড়ি তৈরির মেশিনও তৈরি করছে। ওই মেশিনে ঘণ্টায় ৪০ কেজি মুড়ি ভাজা হবে। কুমোরদের মাটির পাত্র তৈরির স্বয়ংক্রিয় হুইল তৈরি করেছে তারা। এ ছাড়া শালপাতা, ধূপকাঠি, পাটের দড়ি ও সুতুলি তৈরির মেশিনও উদ্ভাবন করেছে খড়্গপুর আইআইটি। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, “গ্রামীণ নানা ক্ষেত্রে কম শ্রম দিয়ে মানুষজন যাতে বেশি লাভ করতে পারেন, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.