Advertisement
Advertisement

Breaking News

মোটা মাইনের ফাঁদ, ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে কৈশোর কাটছে ক্রীতদাস হয়ে

পূর্ব বর্ধমান জুড়ে অসাধু চক্রের রমরমা।

Teenage boys are trafficked to other state ,forced to work as a bonded labour
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:December 4, 2017 9:58 am
  • Updated:September 21, 2019 12:13 pm

সৌরভ মাজি, বর্ধমান: মোটা মাইনে। নামমাত্র যোগ্যতায় কাজ। এমন বিজ্ঞাপনের টোপে বর্ধমানে দিকভ্রষ্ট কিশোররা। ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে তাদের কার্যত ক্রীতদাসের মতো অবস্থা। কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন। যারা পারেননি তাদের অবস্থা অসহনীয়। কীভাবে চলছে এই চক্র। রোগ সারাতে কী করছে প্রশাসন। সংবাদ প্রতিদিন-এর অন্তর্তদন্তে উঠে এল চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য।

ঘটনা ১: 

Advertisement

বছরখানেক আগের কথা। আউশগ্রামের ছোড়া এলাকা থেকে একদল গ্রামবাসী তামিলনাড়ুর ত্রিশূরে মোটা মাইনের টোপে কাজে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা কার্যত ক্রীতদাসে পরিণত হয়। ‘বন্ডেড লেবার’ করে রাখা হয়েছিল। কাজ করলেও বেতন মিলত না। সামান্য কারণে মারধর। এমনকী অশালীন আচরণও জুটত। কর্মস্থলের বাইরে বেরনোর উপায় ছিল না। অপরাধ না করেও যেন কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছিল তাঁদের।

Advertisement

ঘটনা ২: 

জামালপুরের বলরামপুরের রবি দোলুই। মোটা মাইনের লোভ দেখিয়ে গুজরাটের রাজকোটে কাজে নিয়ে গিয়েছিল এক দালাল। তার পরিণতির কথা শুনলে যে কারওর গায়ে কাঁটা দেবে। মাইনে দূরের থাকা, দিনের পর দিন পাশবিক অত্যাচার করা হয় তার উপর। মারধর, গরম লোহার রডের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। এমনকী বাড়ি ফিরতে চাইলে দাবি করা হয়েছিল মুক্তিপণ। অকথ্য অত্যাচারে রবি কার্যত ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে। তখন বেগতিক দেখে তাকে গ্রামে ফেরায় দালালরা। তবে নিজের বাড়িতে নয়, গোপন ডেরায় আটকে রাখা হয়েছিল।

[বাজারে গিয়ে রংচঙে মাছ পছন্দ? আপনিই কিন্তু জালে পড়ছেন!]

এই দু’টি ঘটনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আরও কত জন মোটা টাকা রোজগারের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে জীবন্ন বিপন্ন করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে ক্রীতদাসের জীবন কাটাচ্ছেন অনেকেই। আর ভিনরাজ্যে কাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক শ্রেণির দালাল বা এজেন্ট জেলা জুড়ে জাল বিছিয়ে রেখেছে। দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েরাই তাদের টার্গেট। এর ফলে বর্ধমান জেলা জুড়ে স্কুলছুট বাড়ছে। কেউ অষ্টম শ্রেণি পাশ করেই স্কুল ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিনরাজ্যে।

[ভালবাসা ‘ছিনতাই’ করে অপরাধে হাত পাকাচ্ছে আগামীর ক্রিমিনালরা]

গত বছর জুলাই মাসে আউশগ্রামের ছোড়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। ১৭ জনের দলের মধ্যে ১১ জন কোনওক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে পারেন। তাঁরা পুলিশর দ্বারস্থ হন। ত্রিশূরের গোপন ডেরায় তখনও বন্দি ছয় জন কিশোরী-মহিলা। জেলা পুলিশ সেখানে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে। উদ্ধার করা হয় ওই বন্দিদের। জামালপুরের রবির সঙ্গে আরও কয়েকজনকে কাজে নিয়ে গিয়েছিল বেড়ুগ্রামের সুশোভন পোড়েল। হুগলির তারকেশ্বরের চৌতারা গ্রামের আলমগরীরের সংস্থায় তাদের কাজে লাগানো হয়। অভিযোগ, সেখানে তাদের ঠিকমতো খেতে দেওয়া হত না। কথায় কথায় মারধর করা হত। বেতন জুটতই না। বাকি কিশোররা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু রবি পরিবারের তা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। ফলে ক্রীতদাসের জীবন কাটাতে থাকে সে। তার উপর অত্যাচারের মাত্রা দিনের পর দিন বেড়েই চলে। মৃতপ্রায় অবস্থায় রবিকে কিছুদিন আগে বেড়ুগ্রামে সুশোভনের বাড়িতে দিয়ে যায় আলমগীরের স্ত্রী। সেখানেও বন্দিজীবন শুরু হয় রবির। একদিকে সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, সঙ্গে গৃহবন্দি হয়ে থাকা। ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়নি তার।

[এক ফোনেই বাড়িতে রান্নার গ্যাস, প্রতিবার ঠকে যাচ্ছেন না তো?]

স্থানীয়রা কোনওভাবে বিষয়টি জানতে পেরে উদ্ধার করেন রবিকে। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। অভিযুক্তদের তিনজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। রবির উপর অত্যাচারকে মধ্যযুগীয় বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করেছেন জামালপুরের বিডিও সুব্রত মল্লিক। চিকিৎসক পার্থ সিনহা রবির চিকিৎসা করতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন। পাশবিক অত্যাচার বললেও কম বলা হবে এই ঘটনাকে। জানান সেই চিকিৎসক।

asc-adivasi-workers-in-brick-production-activities

বারবার এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় চিন্তা বাড়ছে নাগরিক সমাজ। জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক অরূপকুমার চৌধুরি জানান, স্কুলে ড্রপআউট প্রিভেনশন ক্লাব গড়েছেন তাঁরা। নাদনঘাটের রামপুরিয়া হাইস্কুলের এই ক্লাব সাফল্য পাচ্ছে। এই ক্লাবের লক্ষ্য, প্রলোভনের ফাঁদে পড়া পড়ুয়াদের ‘বাঁচানো’। কাজের ফাঁদ থেকে তাদের ফের স্কুলে টেনে আনা। পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসনও কিশোর-কিশোরীদের ভিনরাজ্যে কাজে যাওয়া আটকাতে উদ্যোগী হয়েছে। কোন কোন এলাকা থেকে বেশি সংখ্যায় কিশোর-কিশোরীকে ভিনরাজ্যে কাজে পাঠানো হচ্ছে তা চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জেলার কয়েকটি ‘পকেট’ ইতিমধ্যে চিহ্নিতও করা হয়েছে। ওই এলাকাগুলি হল জামালপুর, পূর্বস্থলী, মেমারি, আউশগ্রাম, কাটোয়া, গলসি, বর্ধমান, কালনা। জেলা শাসক জানিয়েছেন, ওইসব জায়গায় সচেতনতার প্রচার করা হবে ধারাবাহিকভাবে। বাইরের রাজ্যে কিশোর-কিশোরীদের কাজে পাঠালে তাদের কী ক্ষতি হতে পারে, পড়াশোনা করলে কী কী উপকার হবে তা বোঝানো হবে কিশোর-কিশোরীদের অভিভাবকদের। সচেতনতার প্রচারে লোকশিল্পীদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে জামালপুরে এই ধরণের সচেতনতা শিবিরও হয়েছে।

জেলা শাসক অনুরাগী শ্রীবাস্তবের সংযোজন, এক সপ্তাহের বেশি কোনও পড়ুয়া স্কুলে না এলে তাদের চিহ্নিত করা হবে। বিডিও-কে রিপোর্ট করতে হবে কেন সেই পড়ুয়ারা স্কুলে আসছে না। জামালপুরের সচেতনতা শিবিরে এসে বর্ধমানের মহকুমা পুলিশ আধিকারিক শৌভনিক মুখোপাধ্যায় বলেন, “নাবালক বা কিশোরদের ভিনরাজ্যে কাজে পাঠানোর পিছনে অভাব একটা কারণ বটে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ সামাজিক সচেতনতার অভাব। শিশুদের সুরক্ষায় আইন রয়েছে। কিন্তু সচেতনতার অভাব রয়েছে।” জেলা শিশু কল্যাণ কমিটির চেয়ারম্যান দেবাশিস নাগের বক্তব্য, “এটি একটি জাতীয় সমস্যা। শিশুদের উপর যে কোনও ধরনের অত্যাচার রুখতে প্রয়োজন জনজাগরণের। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।” বর্ধমান সদর দক্ষিণ মহকুমা শাসক অনির্বাণ কোলে বলেন, “শিশু শ্রম আটকাতে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। প্রশাসনের তরফে পুতুল নাচ, পথনাটিকা, গ্রামীণ যাত্রার মাধ্যমে সচেতনতার প্রচার করা হচ্ছে।”

বর্ধমানে সচেতনতামূলক সভা
বর্ধমানে সচেতনতামূলক সভা

কোনও একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর চারদিকে হইচই হয়। প্রশাসনের তরফে বাড়তি উদ্যম দেখানো হয়। তার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাপা ধামাচাপা পড়ে যায়। আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে দালালরা। ভিনরাজ্যে ক্রীতদাস পাঠানোর ছক শুরু হয়ে যায়। এক স্কুল শিক্ষক বলেন, “এইসব দালালদেরও চিহ্নত করতে হবে। তারাই মূলত দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে, মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ভিনরাজ্যে কাজে নিয়ে যায় পড়ুয়াদের, কিশোর-কিশোরীদের। তাদের চিহ্নিত করলেই হবে না তাদের বিরুদ্ধেই কড়া আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না।”

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ