কৃষ্ণকুমার দাস: সূর্য উঠলেই রাঙামাটির পথে ছুটেছে তাঁর কালো রঙের জাইলো গাড়ি। গোধূলির আলো নিভতেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে পৌঁছে যাচ্ছেন রাজারহাটের ক্যানসার হাসপাতালের ভেন্টিলেশনে থাকা প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশে। তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক, ভোটের দামামা, বিরোধীদের ফুৎকারে ওড়ানো, বর্ণময় কর্মসূচি সেরে হাসপাতালের কেবিনের বাইরে রাতজাগা। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এটাই বীরভূমের ‘লৌহমানব’-এর দৈনন্দিন রুটিন।
অনুব্রত মণ্ডল। বীরভূম জেলা তৃণমূলের দাপুটে সভাপতি, মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহের কেষ্ট। ভারী-দীর্ঘ চেহারা, হাস্যরস মেশানো চোখা রাজনৈতিক-আক্রমণাত্মক মন্তব্য করায় গোটা বাংলায় আজ তিনি অদ্বিতীয়। কিন্তু এই ‘লৌহমানব’-এর অন্দরমহল প্রতি মুহূর্তে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে প্রিয়তমা স্ত্রী ছবিরানির গুরুতর অসুস্থতায়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ফাঁকে ঘন ঘন ফোন করছেন হাসপাতালে। ছায়াসঙ্গী অভিজিৎ সিং ওরফে রানার ফোনে জেনে নিচ্ছেন স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা। ফোনের ওপারের খবর শুনতে শুনতে চোয়াল শক্ত হচ্ছে, কখনও চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। দৃশ্য দেখে মুহূর্তে সহকর্মীরা বিমূঢ়। কিন্তু ‘কেষ্টদা’র হুইপে পরমুহূর্তে সবাই ফিরছেন পঞ্চায়েতি লড়াইয়ে। স্বয়ং অনুব্রত বলছেন, “দলের সৈনিক আমি, দিদির অপির্ত দায়িত্ব পালনে আমৃত্যু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ব্যক্তিগত-পারিবারিক সমস্যা, সঙ্কট দলে আজও প্রভাব ফেলেনি। আগামিতেও ফেলবে না।” মঙ্গলবার রাজারহাটের হাসপাতালে থাকার কথা ছিল, কিন্তু নির্বাচন কমিশন আগের রাতে মনোনয়ন জমার দিন বাড়িয়ে দিতেই কর্মীদের অবাক করে বিনা নোটিসে বোলপুর-সিউড়ির দলীয় অফিসে হাজির হয়েছেন ‘কেষ্টদা’। ৩০ জানুয়ারি বাড়িতে আচমকাই মাথা ঘুরে পড়ে যান অনুব্রত-পত্নী ছবিরানি। ভর্তি হন কলকাতার অ্যাপোলোতে। এএমআরআই রিপোর্টে ধরা পড়ে ছবিদেবীর ফুসফুসের ক্যানসার ছড়িয়েছে মস্তিষ্কেও। পরদিনই স্ত্রীকে নিয়ে মুম্বইয়ের টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে পৌঁছে যান তিনি। মুম্বইয়ে রেডিওথেরাপির পর কেমোথেরাপি দিতে আনা হয় রাজারহাটের ক্যানসার হাসপাতালে। বিমানবন্দরে ছবিরানিকে আনতে সেদিন ছিলেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। এয়ারপোর্ট থেকে সটান রাজারহাটের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু। মায়ের অসুস্থতা ধরা পড়ার পর থেকে বাবার নজরদারির মধ্যেই ২৪ ঘণ্টা পাশে রয়েছে একমাত্র মেয়ে সুকন্যা।
স্ত্রীর আরোগ্য কামনায় ইতিমধ্যে পুরীর জগন্নাথ, তিরুমালা তিরুপতি, উজ্জয়নীর মহাকাল, নেপালের পশুপতি মন্দিরেও পুজো পাঠিয়েছেন অনুব্রত। পুজো দিয়েছেন কালীঘাট, তারকেশ্বর ও বীরভূমের পঞ্চপীঠে। চাদর চড়িয়েছেন দাতাবাবার মাজারেও। বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দিরের অন্যতম প্রধান পুরোহিত তুঙ্গনাথ ত্রিপাঠী নিজে রাজারহাটের হাসপাতালে এসেছিলেন বিগ্রহের পুজোর ভস্ম ও ফুল নিয়ে ছবিদেবীকে দিতে। দেবতার উপর ভরসা করেও সন্ধ্যা হলেই স্ত্রীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকছেন লৌহমানব। তবে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যে একদিনও জেলায় দলীয় কোনও কর্মসূচির পরিবর্তন হয়নি। বিষয়টি স্বীকার করছেন জেলার মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহারা। একটা বিষয় বলতেই হবে, তাঁর কালো গাড়িতে থাকছে নিজের একব্যাগ ওষুধ ও অক্সিজেন সিলিন্ডার। কারণ, স্বয়ং অনুব্রতর হাই ব্লাডপ্রেশার, সুগার, কোলেস্টেরল, লিভার-সমস্যা, হাঁপানি, তীব্র শ্বাসকষ্টও। প্রাতরাশ, মধ্যাহ্ন ও নৈশভোজের পর প্রতিদিনই ৪২-৪৫টি ট্যাবলেট খেতে হয়। আর শ্বাসকষ্ট রুখতে পকেটে ঠাঁই পেয়েছে চারটি নানা গোত্রের ইনহেলার। জনসভায় বক্তৃতার আগেই ‘ফস-ফস’ করে দু’তিনটি ইনহেলার মুখের মধ্যে মেরেই শুরু করেন ঝোড়ো আক্রমণ। মাত্র আট-নয় মিনিটের বক্তৃতা। তাতেই তোলপাড় হচ্ছে রাজ্য রাজনীতি।
গত দু’মাসে দলের একাধিক মহিলা সম্মেলনে গিয়ে স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য নিজেকে দায়ী করেছেন। এভাবেই যখন আবেগঘন বক্তৃতা করেন অনুব্রত তখন জনসভার হাজার হাজার মহিলাদের চোখের পাতাও ভিজে ওঠে। অনুশোচনায় বিদ্ধ কেষ্ট বলেন, “আমার স্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতার জন্য দায়ী আমিই। তাঁর খেয়াল রাখিনি। বামজমানায় যখন ঘরছাড়া ছিলাম তখন দুশ্চিন্তায় রাত জাগার ধকল নিতে না পেরে দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন। ডাক্তাররা বলছেন, ক্যানসারের মূল কারণ টেনশন, মানসিক যন্ত্রণা। তাঁর সেই যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে আমার জন্যই।” চোখ ছল ছল করে উঠে লৌহমানবের। বাকরুদ্ধ হয়ে যান জনসভার মা-বোনেরা। ছবিরানির আরোগ্য কামনায় হাত জোড় করে প্রার্থনা করেন সবাই, বেজে উঠে শাঁখ, উলুধ্বনি। নীরবে গাড়িতে উঠে অনুব্রত রওনা দেন ভেন্টিলেশন কেবিনের উদ্দেশে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.