পলাশ পাত্র, তেহট্ট: নদিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির আঁতুরঘর হিসেবে পরিচিত করিমপুরের ধোড়াদহ। সেখানেই এবার প্রার্থী দিতে পারল না সিপিএম। এই ধোড়াদহের ব্রাহ্মণপাড়ায় থাকতেন সমরেন্দ্র সান্যাল। যিনি নদিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন। এককথায় এই জেলায় সমরেন্দ্র সান্যালকে কমিউনিস্ট পার্টির জনক বললে অত্যুক্তি হবে না। যিনি মটর সান্যাল নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় ব্রাহ্মণ পাড়ায় তাঁর বসত বাড়িই হল ধোড়াদহ সমরেন্দ্র সান্যাল স্মৃতি পার্টি অফিস। যে বাড়ি জেলায় সিপিএমের গর্ভগৃহ নামেই চিহ্নিত। বাড়ির নিজের অংশটুকু পার্টিকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। একটা সময় বাঘা বাঘা নেতাদের ভিড়ে গমগম করত এই পার্টি অফিস। তবে সেদিন আজ আর নেই। পলেস্তারা খসেছে পার্টি অফিসের। বয়সকালে বৃদ্ধ বৃদ্ধরা যেমন একা হয়ে যান, সমরেন্দ্র সান্যাল স্মৃতি পার্টি অফিসেরও বর্তমান হাল কতকটা তাই।
সারা দিনে কেউই পার্টি অফিসের দরজা খোলেন না। যদিও একটা সময় ভিড় লেগে থাকত এ চত্বরে। তখন সিপিএমের শাসন। কে আসেননি এই পার্টি অফিসে! সমরেন্দ্র সান্যাল স্মৃতি পার্টি অফিস তখন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের উপবন। জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের নামজাদা নেতারাও পায়ের ধুলো দিয়েছেন। সমরেন্দ্রবাবুর হাত ধরেই উঠে এসেছেন প্রয়াত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। এসেছেন করিমপুরের বিধায়ক চিত্ত বিশ্বাস, প্রফুল্ল ভৌমিক যাঁরা একসময় এই অফিস আলোকিত করতেন। সেদিনের ঐতিহ্যবাহী পার্টি অফিসে আজ ধুলোর বহর। একসময় হাজারো গলা যেখানে উদাত্ত আওয়াজে ভরিয়ে রাখত সেখানে আজ শুনসান। বেশিরভাগ সময়ই তালাবন্ধ থাকা পার্টি অফিসে শুধু বৈঠক থাকলে দরজা খোলে।
করিমপুর দুই নম্বর ব্লকের ধোড়াদহ এক নম্বর পঞ্চায়েত এলাকায় হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়েরই বাস। ১৩ আসনের এই পঞ্চায়েতের সবকটিতে প্রার্থী দিয়েছে তৃণমূল। বিরোধী বিজেপি ছ’টি, কংগ্রেস পাঁচটি, অন্যান্যরা তিনটি আসনে মনোনয়ন দিতে পারলেও আশ্চর্যজনকভাবে সিপিএম কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি। গত পঞ্চায়েতে ১৩টি আসনের মধ্যে সিপিএম ১১টি আসনে ও কংগ্রেস দুটিতে জয়লাভ করেছিল। বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান মটর সান্যালের বসতভিটেতে সিপিএমের এই অবক্ষয়ে রাজনৈতিক মহলও স্তম্ভিত। করিমপুরে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম বিধায়ক, তথা আমৃত্যু দলের জেলা সম্পাদক মটরবাবু নিজের গরজে সংগঠন করতেন। পার্টির স্বার্থে একসময় সাইকেল চড়ে জেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে গিয়েছেন। অকৃতদার মানুষটি ধোপ দুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবি পরে সাইকেল চেপেই করিমপুর যেতেন। এই পাড়াতেই রয়েছে নদিয়ার প্রাচীন দুর্গাপুজোর অন্যতম ধোড়াদহ জমিদার বাড়ি। এখনও পুজো হয়। সান্যাল বাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তা থাকা জমিদার বাড়ির ছেলে, প্রাক্তন তৃণমূল ব্লক সভাপতি অর্ঘ্য চৌধুরি বলেন, ‘উনি আমার মামাতো দাদু ছিলেন। ওনার দাদা ছিলেন কংগ্রেসের মন্ত্রী নলিনাক্ষ সান্যাল। এক বাড়িতেই দু’জন ওই মাপের মানুষের বাস ছিল। তখন রাজনীতিটা একটা জায়গায় ছিল। মটরদাদু মারা যাওয়ার পর নয়ের দশকের শেষে দলটা নীতিভ্রষ্ট হল। ধান্দাবাজ, সুদখোর, প্রমোটার ঢুকে পড়ে শেষ করে দিয়েছে। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে।’ মটর সান্যালের সংস্পর্শে এসে ছোট বয়সে কমিউনিস্ট ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ হন বিশ্বনাথ সরকার। গত চল্লিশ বছর ধরে এই পার্টি অফিস তিনিই আগলে রেখেছেন। বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘ওনাকে আমি দাদু বলতাম। আজকে আমাদের সঙ্গে মানুষ নেই দেখে খারাপ লাগে। একসময় ওই এলাকায় আমাদের পার্টি সদস্য অনেক থাকলেও এখন ১৩জন। প্রার্থী না দিতে পারার অনেক কারণ আছে। তবে আমাদের সংগঠনের জন্য প্রার্থী দিতে পারিনি।’ সিপিএমের করিমপুর এরিয়া কমিটির সম্পাদক অজয় বিশ্বাস শাসক তৃণমূলকেই কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তৃণমূলের সন্ত্রাসে আমরা প্রার্থী দিতে পারিনি।’ ঘটনা প্রসঙ্গে ধোড়াদহ একের তৃণমূল অঞ্চল সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিকি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী এত উন্নয়ন করেছে যে সিপিএম প্রার্থী খুঁজে পায়নি।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.