সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ডহারবার: প্রায় ত্রিশ বছর বাদে হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা ছেলেরা। ষাটোর্ধ্ব রুক্মিণীদেবীকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সোমবারই গঙ্গাসাগরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন তাঁর তিন ছেলে। হারিয়ে যাওয়া মাকে ছেলেদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে খুশি পশ্চিমবঙ্গ হ্যাম রেডিও ক্লাবের সদস্যরাও।
বিহারের ছাপরা জেলার বাসিন্দা রুক্মিণীদেবী বছর ত্রিশ আগে বড় ছেলে মিথিলেশ, মেজো ছেলে দীনেশ এবং ছোট ছেলে দীপককে নিয়ে ট্রেনে চেপে আসছিলেন কলকাতায় কর্মরত স্বামী রামনাথ রায়ের কাছে। ট্রেনের জন্য বারাউনি স্টেশনে ছেলেদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। মিথিলেশের বয়স তখন চোদ্দো। ছোট্ট দীনেশ এবং কোলের ছেলে দীপককে মিথিলেশের কাছে রেখে রুক্মিণীদেবী ‘আসছি’ বলে আর ফিরে আসেননি। মাকে ফিরে আসতে না দেখে তিন ছেলে তখন কান্নাকাটি শুরু করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্ল্যাটফর্মে তাদের চিনতে পেরে বাড়িতে পৌঁছে দেন। কিন্তু রুক্মিণীদেবীর আর কোনও হদিশ মেলেনি।
ত্রিশ বছর বাদে গঙ্গাসাগরের একটি ফ্লাডসেন্টারের বারান্দায় ষাটোর্ধ্ব এক অপরিচিত বৃদ্ধাকে দেখে সন্দেহ জাগে হ্যাম রেডিও ক্লাবের সদস্য দিবস মণ্ডলের। হ্যাম রেডিও ক্লাবের পশ্চিমবঙ্গের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস জানিয়েছেন, এ বছরই প্রথম দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলাশাসক পি উলগানাথনের উৎসাহে গঙ্গাসাগর মেলা শেষে হ্যাম রেডিওর সদস্যরা সাগরদ্বীপ জুড়ে বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালানো শুরু করেন। উদ্দেশ্য মেলাশেষে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে তাঁদের প্রিয়জনেদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। আর সেই তল্লাশি চালাতে গিয়েই দেড়মাস আগে দিবস সন্ধান পান রুক্মিণী দেবীর। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করাতে তাঁরা কিছুই বলতে পারেননি। তাঁরাই ফ্লাডসেন্টারের বারান্দায় আশ্রয় নেওয়া বৃদ্ধাকে প্রতিদিন নিয়ম করে খেতে দেন। বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করায় নিজের নামটুকু ছাড়া আর কোনও ঠিকানা এবং আত্মীয়-পরিজনদের কথা বলতে পারেননি তিনি। চাপাচাপি করাতে ওই বৃদ্ধা তাঁর বাড়ি কখনও কলকাতার বেলেঘাটায়, কখনও হরিয়ানার একটি গ্রামে, আবার কখনও মেটিয়াবুরুজের রবীন্দ্রনগর, কখনও বা রাজস্থানে বলে জানাতে থাকেন। হাল ছাড়েননি দিবস। ওই বৃদ্ধার কথা তিনি ক্লাবের সদস্যদের জানান। প্রায় দেড়মাস ধরে রেডিও ক্লাবের সদস্যরা চেষ্টা চালাতে থাকেন বৃদ্ধার আসল ঠিকানা জানার। শেষমেশ জানা যায়, রুক্মিণী দেবী নামে এক মহিলা বছর ত্রিশ আগে বারাউনি স্টেশন থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি বিহারের ছাপরা জেলার মুফাসিল থানার বাজিপুর গ্রামে। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাম রেডিও ক্লাবের সদস্যদের মাধ্যমে গঙ্গাসাগর থেকে রুক্মিণী দেবীকে সামনে রেখে ভিডিও কলে যোগাযোগ করা হয় ওই গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে। ভিডিও কলে রুক্মিণী দেবীকে দেখেন মিথিলেশ ও তাঁর আত্মীয়-পরিজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা। কিন্তু দু’পক্ষের কেউই কাউকে চিনতে না পারায় সমস্যায় পড়ে যান ক্লাবের সদস্যরা। একসময় দীপক রায়ের নামটি শুনে হঠাৎই চোখে জল এসে যায় রুক্মিণী দেবীর।
বাজিপুর গ্রামে পৌঁছে যান রেডিও ক্লাবের সদস্যরা। মিথিলেশের ছেলে অর্থাৎ রুক্মিণীদেবীর নাতি অমিত রেডিও ক্লাবের সদস্যদের জানায়, “মেরা উমর ২২ সাল, আউর ও লাগতা হ্যায় কম সে কম ২৫-৩০ সাল পেহলে, হাম তব পয়দা নেহি হুয়া, আপ ঘর চালিয়ে, ঘরয়ালে পহেচান লেগা।” কিন্তু কে চিনবেন রুক্মিণী দেবীকে? স্বামী রামনাথ গত হয়েছেন তা প্রায় দশ বছর হল। নাতি তো দূরের কথা, মায়ের হারিয়ে যাওয়ার সময় তিন ছেলেও ছিল অনেক ছোট। তাই মায়ের সেদিনের মুখটাও আর মনে পড়ে না তাঁদের। শেষে রুক্মিণীদেবীর ছবি নিয়ে যাওয়া হল পরিবারের একমাত্র প্রবীণ সদস্যা রুক্মিণী দেবীর জা-য়ের কাছে। দেখামাত্রই চিনতে পারলেন তিনি রুক্মিণীদেবীকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবি ঘুরে বেড়ালো গোটা গ্রাম জুড়ে। প্রবীণ বাসিন্দারা সকলেই শনাক্ত করলেন এই ছবি ত্রিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া রুক্মিণীদেবীরই। সঙ্গে সঙ্গে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় তাঁকে ঘরে ফেরানোর। বিহারের ছাপরার বাড়ি থেকে বৃদ্ধার তিন ছেলে ইতিমধ্যেই মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রওনা দিয়েছেন গঙ্গাসাগরের উদ্দেশে। এদিনই তাঁদের সাগরদ্বীপে পৌঁছনোর কথা। রুক্মিণীদেবীর প্রতিবেশী নন্দকিশোর যাদব ফোনে জানান, এই ঘটনায় রীতিমতো আনন্দিত গোটা গ্রামের মানুষ। এভাবে যে ত্রিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ওই মহিলাকে ফের ফিরে পাওয়া যাবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁরা। রুক্মিণীদেবীর পরিবার জুড়েও বয়ে যাচ্ছে খুশির বন্যা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.