Advertisement
Advertisement

Breaking News

Birsa Munda

জ্বলছে আজও উলগুলানের আগুন

১২৫ বছর পরেও বিরসা মুন্ডার দেখানো পথ এবং 'উলগুলান'-এর আদর্শ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

A special tribute to Birsa Munda on his 125th death anniversary
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 9, 2025 5:54 pm
  • Updated:June 9, 2025 6:23 pm  

১৮৯৪ সালে জোরালভাবে ‘খুঁটকাটি’ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের দাবি তোলেন বিরসা মুন্ডা। আন্দোলন গড়ে তোলেন ভূমিহীন আদিবাসীদের মধ্যে। বিরসার নেতৃত্বে সংঘটিত হয় এক বিশাল জনযুদ্ধ। ব্রিটিশদের সুসংগঠিত সামরিক শক্তির কাছে পরাজিত হয়েও, আজও বেঁচে আছে বিরসার সেই ‘উলগুলান’। লিখছেন বুদ্ধদেব হালদার।

 

ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে সেদিন শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন মা! কেউ বলেন বিরসা জেলের মধ্যে কলেরায় মারা গিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে কারাগারের মধ্যে বিষপ্রয়োগে মেরে ফেলেছিল। ব্রিটিশরা ভেবেছিল, তরুণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো উলগুলানের যবনিকাপাত ঘটবে। কিন্তু সেই উলগুলানের আগুন আজও ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদিবাসী জনজাতির মনে জাগরুক। রাঁচির ব্রিটিশ কারাগারে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ঠিক আজকের দিনেই ৯ জুন, ১৯০০ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ‘ধরতি আবা’ বিরসা।

মুরজু ব্লকের বুরুজু উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাইবাসার একটি জার্মান মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন বিরসা। আর এখানেই তাঁকে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। তাঁর নতুন নাম হয় দাউদ মুন্ডা বা দাউদ বিরসা। খ্রিস্টান মিশনারিদের ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আদিবাসীদের নিজস্ব অস্তিত্বকে এক কঠিন সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। আর ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই বিরসা ‘উলগুলান’-এর ডাক দিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কেবল রাজনৈতিক পরাধীনতা নয়, তা আদিবাসীদের ‘জল, জঙ্গল, জমিন’-এর উপর এক ভয়ঙ্কর আগ্রাসন। ব্রিটিশ শোষণ, বঞ্চনা ও ভূমিচ্যুতি আদিবাসী জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। আদিবাসীদের ভুমি অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল জমিদাররাও। বিরসা মুন্ডা ১৮৯৪ সালে জোরালোভাবে ‘খুঁটকাটি’ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের দাবি তোলেন। আন্দোলন গড়ে তোলেন ভূমিহীন আদিবাসীদের মধ্যে। বিরসার নেতৃত্বে সংঘটিত হয় এক বিশাল জনযুদ্ধ।

১৮৯৯-১৯০০ সালের মুন্ডা বিদ্রোহের মূল লক্ষ ছিল ব্রিটিশ শাসন ও জমিদারদের শোষণ থেকে আদিবাসীদের মুক্তি দেওয়া। শুধু তাই নয়, ‘বিরসাইত’ মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে তিনি আদিবাসী সমাজের নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। আদিবাসীদের মধ্যে ঐক্য ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এই সংগ্রাম শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ছিল না। তা ছিল এক প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে, যেখানে মহাজন, জমিদার ও ঔপনিবেশিক শক্তির সম্মিলিত শোষণ প্রান্তিক মানুষকে তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য করে তুলেছিল। তাঁর নেতৃত্বে আদিবাসীরা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শেষপর্যন্ত হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। যদিও ব্রিটিশদের সুসংগঠিত সামরিক শক্তির কাছে এই অসম যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। তবুও বিরসা মুণ্ডার আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাঁর আন্দোলন ব্রিটিশদের বাধ্য করেছিল আদিবাসী ভূমি অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়ণ করতে। ফলস্বরূপ ১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর টেনেন্সি অ্যাক্ট চালু হয়। এটি ছিল আদিবাসীদের ভূমি মালিকানা রক্ষার একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরেও আদিবাসী সমাজ আজও নানা আগ্রাসনের স্বীকার। উন্নয়ন ও প্রকল্পের নামে ভূমিচ্যূতি, শিক্ষাগত অনগ্রসরতা, সামাজিক বঞ্চনা আজও তাদের জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আজ ১২৫ বছর পরেও বিরসা মুন্ডার দেখানো পথ এবং ‘উলগুলান’-এর আদর্শ তাই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মুন্ডা বিদ্রোহের মূল বার্তা ছিল ন্যায়বিচার, ভূমি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। এই বার্তা আজও প্রতিটি আদিবাসী মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। যখনই কোনো আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কায় থাকে, যখনই তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে, তখনই বিরসা মুন্ডার ‘উলগুলান’-এর অগ্নিশিখা জ্বলে ওঠে আদিবাসী সমাজের শোণিতে।

তাঁর দেখানো পথে প্রান্তিক মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সকলকে সচেতন হতে হবে। দেশ ও দশের অগ্রগতি শুধু অর্থনৈতিক সূচকে পরিমাপ্য নয়। বরং কতখানি আমরা সমাজের দুর্বলতম অংশের প্রতি সংবেদনশীল ও তাদের অধিকার রক্ষায় বদ্ধপরিকর হতে পেরেছি, তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এক বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরসা মুণ্ডার অসমাপ্ত সংগ্রাম আজও আমাদের শক্তি যোগায়। তাঁর আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার প্রচেষ্টাই আজকের এই বিশেষ দিনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement