Advertisement
Advertisement
Iran

মহাবিশ্বের চেয়েও রহস্যময় নারীশরীর!

সামাজিক চোখরাঙানির সেই একই ঢঙের পুরনো কাহিনিই শোনাল ইরানের হিজাব বিদ্রোহ।

A write up on the hijab revolt in Iran
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 15, 2024 4:48 pm
  • Updated:November 15, 2024 4:48 pm  

যেন মহাবিশ্বের গভীর রহস্যের চেয়েও আরও বেশি রহস্য জড়িয়ে রয়েছে নারীশরীরে। হিজাব না-পরলে মেয়েদের মার খেতে হয়, কেউ-বা প্রতিবাদে অন্তর্বাস ধারণ করে লোকসমক্ষে এলে, তাকে বলা হয় মানসিক ভারসাম্যহীন! লিখছেন কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন

কিছু কথা লিখব। কিন্তু কী লিখব? সেই চিবিয়ে-চিবিয়ে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া নারীর অধিকার বুঝে নেওয়ার একই ক্লান্তিকর গল্প? কী লিখব? মেয়েদের উপর সামাজিক চোখরাঙানির সেই একই ঢঙের পুরনো কাসুন্দি-কিস্‌সা? দখলদারি মনোবৃত্তি নিয়ে সাত-সাতটা মহাদেশ আর পঁাচ-পঁাচটা মহাসাগর ভরা এই পৃথিবীর ইঞ্চি-ইঞ্চিটাক দখল করতে-করতে আমরা সর্বত্র মানুষের শাসন কায়েম করছি। অথচ, কী অদ্ভুতভাবে মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আর সবকিছু সরিয়ে রেখেও শুধু নারী-পুরুষের সবরকম অবস্থানে সমতাটুকু আনতে পারিনি। আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতিতে নিজের কক্ষপথে পাক খেতে-খেতে কবেকার বুড়ো পৃথিবীটা দিনে-রাতে আধুনিক হয়ে গেল। অথচ নিয়মের নিগড়, সামাজিক শাসনের বেড়াজাল থেকে, মেয়েদের সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারা গেল না। সময়ের এগিয়ে চলার সমানুপাতে তাই মেয়েদের উপর অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বেড়েই চলেছে।

Advertisement

পুরুষতান্ত্রিকতার নটেগাছগুলিও মুড়োচ্ছে না। বরং বিষম বৈপরীত্যে মাথাচাড়া ও মাথাঝাড়া দিয়ে উঠছে।
এবার কথা থেকে কথার কথা পেরিয়ে আমরা এক দৃশ্যের ভিতরে ঢুকে যাব। সেই দৃশ্যে দঁাড়িয়ে রয়েছে ইসমাতারা, কয়েক জোড়া লাল চোখের সামনে। যুবতী সে। বয়স ২৫-২৬। উপচে পড়া রূপ তার। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। সেটাই ইসমাতারার না-পসন্দ। কাজেই সে পার্লারে গিয়েছিল হেয়ার স্ট্রেটনিং করাতে। তারপর মেয়েটি আর হিজাব পরেনি। রেশম-রেশম চুল উড়িয়ে তাতে রোদ, হাওয়া ও যত পুরুষের দৃষ্টি লাগিয়ে যখন সে বাড়ি ফিরল, তখন তার মাথা আর নিজের শরীরের অংশ রইল না। চুলও পৈতৃক সম্পত্তি হয়ে গেল।
তার দাদা এসে টেনে ধরল চুল, বাবা তাতে কঁ‌্যাচকঁ‌্যাচ-ঘ্যাসঘ্যাস শব্দ তুলে কঁাচি চালিয়ে দিল। বাসি শাকের অঁাটির মতো মেঝেতে নেতিয়ে পড়ে গেল চুলের গোছা। চুলের সঙ্গে ইসমাতারার স্বাধীনতাও খসে পড়ল এই একুশ শতকে মেঝের উপর। পলক না-ফেলে মৃত একরাশ চুলের দিকে তাকিয়েছিল মেয়েটি, দঁাড়িয়েছিল দারুণ কঠিন এক পাথরের মতো। তার বাবা জানত না, একদিন মেয়েই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবে।

ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আড়াআড়ি দাগ টেনে দিয়ে আড়ে-বহরে, মাপে-পরিমাণে মেয়েদের জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রগুলিকে সংকীর্ণ করে তাদের ভাল থাকার পথ বন্ধ করে দিতে চাইলে একশো এক ইসমাতারা, হাজার এক ইসমাতারা, লক্ষ এক ইসমাতারা প্রতিবাদে পথে নেমে এসে দঁাড়াবে। দঁাড়াবেই। সময় তা-ই বলে। ইতিহাসও।গত সপ্তাহে একটি ভিডিও ‘ভাইরাল’ হল এবং আমরা সেই ভিডিওতে দেখলাম, এক তরুণী তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা চত্বরে এসে দঁাড়িয়েছে অন্তর্বাস পরে। সাহসী মেয়ে। তার সাহসকে কুর্নিশ জানাই। যদিও প্রাথমিকভাবে দেখলে, এর ভিতর স্বাভাবিক শালীনতার অভাব রয়েছে বলেই মনে হবে। কেননা পোশাক পরার ধরনে ও ধারণে অন্তর্বাস পোশাকের ভিতর থাকবে, সেটাই থাকার কথা। পোশাক খুলে কেবল অন্তর্বাস পরে ইতিউতি ঘোরার কথা নয়, শিক্ষাঙ্গনে তো নয়-ই।

তবে মেয়েটি কেন এমন করলেন? সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা জানলাম এক মহিলা সাংবাদিক ওই ভিডিও ফুটেজ ‘পোস্ট’ করে দাবি করেছেন– ঠিকঠাক হিজাব না-পরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাভাবে ওই তরুণীকে হেনস্তা করা হয়। এরপরই সেই ইরানি তরুণী তার পোশাক খুলে শুধু অন্তর্বাস পরে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কখন একটি মেয়েকে তার পোশাক খুলে ফেলতে হয়? শারীরিক, মানসিক, সৌন্দর্যগত সমস্ত প্রয়োজনীয়তাকে ছাপিয়ে গিয়ে একটা পোশাক যখন কড়া বিধি-নিষেধের শাসনে ও শাসানিতে অতিরিক্ত ভারী হয়ে ওঠে, তখন মনে হয়, সেই পোশাকের ভার বহন করার চেয়ে খুলে রাখা ভাল– নারী-পুরুষ উভয়েরই। কেন না, অনবরত অপ্রয়োজনীয় ভার বহনে প্রাণেরও কোনও সুখ নেই, শরীরেরও বড় ক্ষতি। আমরা তো আর ধোপার বাড়ির গাধা নই, যে, ভার বহনের জন্য সারাক্ষণ পিঠ পেতে রেখে দিয়েছি। আমরা মানুষ, সাধের মানুষ জীবন আমাদের। ফলত, আমাদের বেঁচেবর্তে থাকায় কিছু স্বস্তি, কিছু স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দের বড়ই দরকার।
ইরানে ইসলামি শাসনতন্ত্র এবং সেই শাসনতন্ত্রের তর্জনী তোলা পোশাকবিধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নতুন নয়। এমনকী, নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে এ পৃথিবীর নানা প্রান্তে মেয়েদের পোশাক খুলে প্রতিবাদ করাও নতুন নয়। সরকারি আইনমাফিক, ইরানে, মহিলাদের প্রকাশ্যে হিজাব পরা আবশ্যক, এবং এই আবশ্যকতার বিরুদ্ধে মহিলারা বার বার প্রতিবাদ জানিয়েছে।

২০২২ সালে ইরানি তরুণী মাহশা আমিনিকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ, তারও অপরাধ ছিল এই একই– ঠিকঠাক হিজাব না পরা। ভাবতে কেমন অবাক লাগে না! এত, এত ভুলে ভরা এই পৃথিবীর একধারে একদল মানুষ, আর-একদল মানুষের পোশাকের এক-খুঁট থেকে আর-এক খুঁট পর্যন্ত ঠিক-ভুল খুঁজে বেড়াচ্ছে, অন্য ধারে যুদ্ধ, রক্তপাত, হিংসা, অশিক্ষা, অপুষ্টির ভুলে পৃথিবীর শরীরটা যে পক্ষাঘাতে ভরে গেল– সেই ভুলগুলির দিকে তেমন নজর নেই। বড় নজর কেবল নারীশরীরের দিকে। যেন মহাবিশ্বের গভীর রহস্যের চেয়েও আরও বেশি রহস্য জড়িয়ে-জড়িয়ে, ছড়িয়ে-ছড়িয়ে রয়েছে নারীশরীরেই। তাই তার প্রতি এত নিদান, এত বিধান, এত ফিসফিস। অথচ, পুরুষের শরীরের মতোই এ-শরীরও সহজ, স্বাভাবিক। এটাই সত্যি!

যা স্বাভাবিক, তাকে গোপনীয়তার রাংতায় ক্রমশ-ক্রমশ মুড়তে থাকলে সমস্যা বাড়ে। তৈরি হতে থাকে নানা সামাজিক ট্যাবু। মেয়েদের শরীর নিয়ে তৈরি হওয়া ট্যাবুসমূহ তাই মেয়েদের নানামুখী সমস্যার সামনে দঁাড় করিয়ে দেয়। মেয়েবেলা থেকে মহিলাবেলায় পৌঁছতে-পৌঁছতে অগুনতি বার শুনে ফেলতে হয়– তার বুক-মুখ, হাত-পা, কোমর-পিঠ মায় পুরো শরীরটাকেই বেশ সামলে-সুমলে চলতে হবে। কেননা, তা বেশ বিপদবাহী। একটি মেয়েকে নানাভাবে বাধ্য করা হবে মেনে চলতে যত সামাজিক অনুশাসন। কিন্তু এটা আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জোর খাটিয়ে বাধ্যতার সংস্কৃতি তৈরি করতে চাইলে– সেই সংস্কৃতির ফঁাকফোকর দিয়েই অন্য আর-একদিন অবাধ্যতা জোরালো হয়ে উঠবে। এটা সত্যি, যে কোনও বৈষম্যই শেষ পর্যন্ত বিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, আমরা জানি, লিঙ্গবৈষম্যে পোশাকগত বিভাজন থেকেই কিন্তু শুরু হয়েছিল– ‘ফ্রি দ্য নিপল মুভমেন্ট’।

যে-ঘটনাটি ইরানে ঘটেছে সেটি এককভাবে ইরানেরই ঘটনা নয়। বহুমুখ ও বহুরূপ নিয়ে নারী-লাঞ্ছনা, নারী-উৎপীড়নের এমন ঘটনা এ উন্নত ভূখণ্ডের আনাচকানাচে, সব জায়গায় ঘটে চলেছে। এ ঘটনার পরে ইরানি তরুণীটিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ এবং ঘটনাটিকে চাপা দেওয়ার দারুণ চেষ্টায় তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে, যা কার্যত দুর্ভাগ্যের ও যন্ত্রণার। এমন ঘটনাগুলি তো এখনই থামার নয়, ঘটতেই থাকবে। এবং এই বিষয় নিয়ে লিখতে থাকলে লেখাও চলতেই থাকবে। ক্রমশ তা হয়ে উঠবে নারীকথার রামায়ণ, নারীকথার মহাভারত। থাক, আর কিছু লিখব না।
(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement