‘পুষ্পা টু’ বাণিজ্যসফল। তা তেলুগু অস্মিতার সঙ্গে আপস করেনি। বহুভাষিকতার চর্চা চলুক, কিন্তু বাঙালি অস্মিতাকে সম্মান করেই।
‘পুষ্পা টু: দ্য রুল’। ইতোমধ্যে ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে হইচই ফেনিয়েছে। দর্শকরা পরম তৃপ্ত, পয়সা-উশুল মনোভাবে দৃপ্ত পায়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে বলছে মূলত একটাই কথা: হিন্দি সিনেমাকে ধুয়ে দিয়েছেন পরিচালক সুকুমার। এমন সিনেমা ‘সাউথ-ই বানাতে পারে!’ এই মূল্যায়ন কি শুধুমাত্র ধুঁয়াধার অ্যাকশন দেখে? না কি পুষ্পার ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ জীবনচরিতটি এতখানিই ডোন্ট কেয়ার মশালাতে মাখা যে, মাথা নোয়াতেই হয়? দু’টিই সত্য।
পুষ্পা রাজ যেভাবে এই সিনেমায় এন্ট্রি নেয়, তা নেহাত ‘মাইন্ডলেস’ অ্যাকশনের প্রতীক নয়। তাছাড়া, পুষ্পা একবগ্গা হলেও অসভ্য নয়। যে-অফিসারকে সে পছন্দ করে না তাকে ‘সরি’ বলে না, কিন্তু সমাজের চোখে যে-নারীরা পতিতা, দেহপোজীবী বলে চিহ্নিত, তাদের সামনে ‘মুখখারাপ’ করে ফেললে ‘সরি’ বলে। মানে, ঝুঁকতে তার সমস্যা নেই, জোর করে তাকে ঝেঁাকাতে চাইলে, তাকে ঠেস দিলে, মুশকিল। বস্তুত, এখানেই বাজি মারতে চেয়েছেন পরিচালক সুকুমার।
‘পুষ্পা’ ফ্রাঞ্চাইজির প্রথম সিনেমাটি যে-পরিমাণ নাম কিনেছিল, চাইলে কি তিনি দ্বিতীয় পর্বে সিনেমার শরীরে ছত্রে-ছত্রে অান্তর্জাতিক লক্ষণ ভরে নিতে পারতেন না? অান্তর্জাতিক না-হোক, সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটের কথা ভেবে পুষ্পাকে করে তুলতে পারতেন না অনেক মাজাঘষা, গ্রহণীয়, শার্প? পারতেন হয়তো, কিন্তু করেননি, কারণ, তাহলে পুষ্পা চরিত্রটি ছিন্নমূল হত। ‘সাউথ-ই পারে’ এই উজ্জীবিত গ্ল্যামারও সিনেমাটিকে বাড়তি ঔজ্জ্বল্য দিত না।
‘পুষ্পা’ সিনেমাটি হিন্দিতে ডাব্ড হয়েছে, কিন্তু রক্তমাংসের তেলুগু পরম্পরার শিকড় থেকে বিচ্যুত হয়নি, দর্শকদেরও বঞ্চিত করেনি। দর্শক বাঙালি হবে না বিহারি, গুজরাতিতে কথা বলে না কি পাঞ্জাবিতে– এসব পূর্বশর্তে না-মজে সিনেমাটির নিজস্ব আত্মাকে প্রতিষ্ঠিত হতে দিয়েছে। এখানেই উত্তর ভারত পিছিয়ে, বলিউড খেয়েছে গোল, আর সপাটে স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণের দুয়ার খোলার অভিঘাত। অন্ধ্রপ্রদেশের অন্যতম ঐতিহ্যশালী লোকায়ত উৎসব ‘গঙ্গামা যাত্রা’-কে যেভাবে বিনোদনের সঙ্গে সূচিবিদ্ধ করা হয়েছে, তা অভিনব। অর্থাৎ দক্ষিণি রুচি, দক্ষিণি অনুভূতি, দক্ষিণি চালচলন, দক্ষিণি লোকাচার, দক্ষিণি আবেগ প্লাবিত করেছে এই সিনেমাকে।
কথা হচ্ছে– এই সিনেমা দেখে, তাকে ‘দক্ষিণি প্রোডাক্ট’ বলে মানতে আমাদের সমস্যা নেই, এর উৎকর্ষে উদ্বাহু হতেও আমরা প্রস্তুত– অথচ, যদি কোনও শিল্পী বাংলা গান শুনতে নারাজ শ্রোতাকে বাংলা গান না-শোনার জন্য দু’-কথা বলেন, তাতে আমরা চটে যাই, আর এর নেপথ্যে অন্য ভাষার প্রতি অসম্মান, অন্য গানের প্রতি অনাসক্তির কথা ভাবতে পছন্দ করি। বাংলা গান শোনা মানে অন্য ভাষার গান না-শোনা নয়। বহুভাষিকতার চর্চা জারি থাকুক শিল্পে ও সাহিত্যে। কিন্তু ‘বাঙালি অস্মিতা’-র ব্যাপ্তির কথা উঠলে, বুঝতে হবে, আমাদের একটু শক্ত হওয়ার সময় এসেছে। তা না হলে ‘পুষ্পা’ সিনেমাকে দক্ষিণের নির্যাস বলা হয়ে দঁাড়াবে নেহাত ‘ভণ্ডামি’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.