নেশনস লিগের ট্রফি হাতে রোনাল্ডো।
অর্পণ দাস: আপনি কি জীবনযুদ্ধে রোজ পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত? রোজ রাতে দু’চোখের পাতা এক করার আগে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে বিরাট শূন্যের অঙ্ক কষেন? মনে হয়, জীবন কত কী করার ছিল, কত কী করা হয়ে ওঠেনি? না, আর কোনো নতুনত্বের চেষ্টা নয়। জীবন চলুক ধরাবাঁধা পথে। তাহলে দাঁড়ান পথিকবর। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর (Cristiano Ronaldo) আপন ভুবনে আপনাকে স্বাগত জানাই। এখানে আপনি শিখবেন প্রত্যাবর্তনের ম্যাজিক, মাটি কামড়ে পড়ে থাকার আদর্শলিপি। জিতবেন, হারবেন, ব্যর্থতার আঘাত এসে বাজবে বুকে। কিন্তু হারিয়ে যাবেন না। রাতবিরেতে দুঃস্বপ্ন এলে ৭ নম্বর জার্সিধারীর একটা হাত আপনাকে তুলে ধরতে এগিয়ে আসবে। অন্য হাতে ধরা ঝুলিতে কখনও নেশনস লিগ, কখনও পাঁচটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, পাঁচটা ব্যালন ডি’অর, কখনও বা ইউরো কাপের শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি। ও, আরও একটা নেশনস লিগ জুড়ে নিন। রবিবার রাতে যেটা পর্তুগাল স্পেনকে হারিয়ে জিতল।
আপনি বলতেই পারেন, রোনাল্ডো তো কেরিয়ারে প্রায় সব পেয়েছেন। আমাদের মতো প্রাত্যহিকের মার খেয়ে ঘষটে ঘষটে চলতে হয় না। কথাটা ঠিক, আবার ভুল। শুধু পাদপ্রদীপের আলোর চকমকিটাই দেখলেন। একটু ছাই ঘেঁটে খুঁজে দেখুন সাচ্চা ফুটবল ছিল কি না। পর্তুগালের মাদেইরার দরিদ্র পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। আর্থিক অনটনের সঙ্গে নিত্য লড়াই করতে করতেই শরীরে ধারণ করেছেন অক্ষয় বর্ম। কেউ বলেন ‘মনস্টার মেন্টালিটি’, অনেকে হিংসাও করেন। কিন্তু এই যোদ্ধাসুলভ মানসিকতা আছে বলেই পিতার মৃত্যুর পরও লড়াই থেকে সরেন না। কিংবা সন্তানের প্রয়াণের পর নামেন লিভারপুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানানো ছাড়া আর কীই বা করার থাকে আপামর ফুটবল ভক্তদের। এই লড়াইটার নাম জীবন, এই লড়াইটার নাম ফুটবল। এরচেয়ে বড় শিক্ষা আর কী আছে?
তবে এতে যদি ভাবেন যে, জীবনের মন্ত্র শিখে গেলেন, তাহলে ভুল করবেন। স্কিল, ফিটনেস, জেতার খিদে, গোলের গন্ধ পাওয়া- এগুলো বহুচর্চিত। ঈশ্বরপ্রদত্ত শব্দটার সংজ্ঞা রোনাল্ডো বহুদিন হল বদলে দিয়েছেন। কী নিয়ে এসেছি, এটা এখন আর কোনও প্রশ্ন নয়। কথাটা হল, আজ নিজের আয়নায় আপনি কীরকম? আপনি কি আরও একটা দিন লড়াই করার জন্য তৈরি? রোনাল্ডো হওয়ার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এটাই। আজ কটা গোল বা অ্যাসিস্ট করলেন? ক্যাবিনেটে নতুন কী হিরে-জহরত ঢুকল? এইসব প্রশ্ন তাড়া করে বেরোবে। নাহলে নেশনস লিগ এর আগেও জিতেছেন। বলা ভালো, ২০১৯-র উদ্বোধনী মরশুমে জিতে এই ট্রফির কৌলীন্য বাড়িয়েছিলেন।
আর এবার ফাইনালের আগে প্রবল চর্চা শুরু হল রোনাল্ডো বনাম ইয়ামাল। ৪০-এর অভিজ্ঞতা বনাম ১৭-র তারুণ্য। সিআর৭ রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি, আর সেখানে ইয়ামাল বার্সেলোনার ঘরের ছেলে, মেসির ‘শিষ্য’। ওই ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো। আশা করি, আপনি এই ন্যারেটিভের ফাঁদে পা দেননি। ফিটনেস, ফর্ম ধরে রাখতে পারলে ইয়ামাল অনেকদিন খেলবে, গোল করবে, ট্রফি জিতবে। কিন্তু রোনাল্ডোর সঙ্গে ‘বনাম’-এর গল্পে কোনও দিন আসতে পারবে না। দেশের হয়ে ১৩৮ গোল, সব মিলিয়ে ১০০০ গোল থেকে মাত্র ৬২টা গোল দূরে পর্তুগিজ মহানায়ক। এই পরিসংখ্যানে পৌঁছনোই আকাশকুসুম ভাবনা। তারপর আছে একাধিক প্রজন্মকে মোহিত করে রাখার ক্ষমতা। যেটা মেসি করেছেন, রোনাল্ডো করেছেন। বাকিটা শিবের অসাধ্য!
সেটা রোনাল্ডো জানেন। নেশনস লিগ জয়ের পর ইয়ামালকে ভূয়সী প্রশংসায় ভাসিয়ে দিলেন। তার আগে বলেছিলেন, জুনিয়রের সঙ্গে ইয়ামালের মিলের কথা। মেসির সঙ্গে তাঁর বহু বছরের স্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা। গোটা ব্যাপারটা ঠিক রোনাল্ডোসুলভ নয়। নাকি এটাই রোনাল্ডো। আমাদেরই বুঝতে ভুল হয়েছিল। যখন বলতেন, আমার কাছে আমি সবসময় সেরা, তখন ভেবেছি ঔদ্ধত্য। আজ আর সেসব বলার প্রয়োজন পড়ে না। ওসব GOAT বিতর্ক ফেনিয়ে তোলা। দ্বিতীয়বার নেশনস লিগ জয় আর ফাইনালে মহামূল্যবান গোল, শুধুমাত্র সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য। বাকিটা নিজের কাছে জানেন তিনি সেরা। জীবনের পাঠ শেখার জন্য এটা আসলে রোনাল্ডোরই দুনিয়া। ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
অতএব, রোনাল্ডো আপনাকে প্রতিদিন জীবনের ময়দানে লড়ে যাওয়ার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। আজ আরেকবার লড়ে যান। দুনিয়ার প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে নয়, নিজের না-পারার হীনম্মন্যতার সঙ্গে। বিশ্বাস করুন, আপনিই সেরা। যেভাবে সুমন বলেন, ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠে তোমায় দেখবে বলে, হে আমার আগুন, তুমি আবার ওঠো জ্বলে’। সুমনের গানের পঙক্তিরা ‘মাদেইরা, ম্যাঞ্চেস্টার, মাদ্রিদ, তুরিন অ্যান্ড ম্যাঞ্চেস্টার এগেইন’-এ মিলেমিশে যায়। সত্যিই তো ‘আ ওয়াকিং ওয়ার্ক অফ আর্ট’। ব্যর্থতা আসবে, সাফল্যও। জয় আমাদের মাথার ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলবে। যাতে খসে পড়া মাত্রই সাফল্যে দু-আধখানা না হয়ে যাই। এটুকু দোলাচলতা না থাকলে কি আর রোনাল্ডো হওয়া যায়? বয়স তাঁর চোখের কোনায় যতই ত্রিকোণামিতি খেলুক না কেন, তা ফুটবলার রোনাল্ডোকে আরও পরিপূর্ণতা দান করে। ধরে নেওয়া যাক, এই সবে শুরু। এখনও যে বিশ্বকাপ জয় বাকি। নিজের জন্য পরীক্ষার শেষ স্টপেজ। অপেক্ষায় থাকাই যায়। রোজ জীবনের মন্ত্র বলে আপনি আকাশে লাফ দিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে নেমে আসবেন মানুষের পৃথিবীতেই। মাটিতে পা থাকাও যে বড্ড প্রয়োজন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.