Advertisement
Advertisement

‘নোটবন্দি’র দ্বিবার্ষিকী ও ফিরে দেখা

বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটি ‘দোদোমা’-র কী প্রভাব পড়েছে দেশে?

Demonetization in hindsight
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 9, 2018 11:12 am
  • Updated:November 9, 2018 11:12 am

রাজদ্বীপ সরদেশাই: ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে কী করে সাফল্য পেতে হয়, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দক্ষতার কোনও তুলনা নেই! কৃতকর্মের কোনওটিরই বার্ষিকী উদ্‌যাপন তারা ভোলে না।

কিন্তু এ কেমনধারা দ্বিচারিতা! ২০১৮, মানে এই বছর ‘নোটবন্দি’ ঘোষণার দ্বিতীয় বার্ষিকী। অথচ এ ব্যাপারে সরকারের মুখে কুলুপ। দীপাবলির বাজিপটকার শব্দতাড়নায় যেন তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিনের ঢক্কানিনাদ চাপা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ৮ নভেম্বর ২০১৬ দিনটির কথা! কীরকম তোল্লাই সহযোগে গলা ফাটিয়েছিল সরকারের চিয়ারলিডাররা: দুর্নীতি ও কালোবাজারির বিরুদ্ধে এরকম ‘সুবিশাল’ আর ‘দুঃসাহসিক’ পদক্ষেপ কস্মিনকালেও করেননি কেউ।

Advertisement

কিন্তু আজ কী হল? সরকারের দুর্নীতিবিরোধী রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের ফাঁকে নোটবন্দির লাগু হওয়ার সিদ্ধান্তটি এখন ধীরে ধীরে স্মৃতি-গহ্বরের প্রান্তে। যেন উদযাপন করার মতো কোনও এঁটোকাঁটা আর বাকি নেই!

Advertisement

[নোটবন্দি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, টুইট করে কটাক্ষ মমতার]

তুলনায় আনা যাক, এই সেপ্টেম্বরের শেষে ‘এলওসি’-তে ‘পরাক্রম পর্ব’ বা ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক দিবস’ পালন- মোদি সরকারের আরেক কৃতকর্মের দ্বিতীয় বার্ষিকী উদযাপনের ঘনঘটা। প্রধান প্রধান সামরিক ফাঁড়িতে পরপর পাবলিক ইভেন্টের মধ্য দিয়ে চলল এই দিবসের পালন, উদ্‌যাপন। সব জায়গায় সশীরের উপস্থিত না থেকেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন নেতৃত্ব দিলেন। যোধপুরে আয়োজিত সম্মিলিত কমান্ডারদের সম্মেলনে তো নিজেই ছিলেন। সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন, টিভিতে ফুটেজ প্রচারের মধ্য দিয়ে আভাস স্পষ্ট যে, মোদি সরকার দিনটিকে নিজেদের ‘বিজয় দিবস’ রূপে ঠাওরাতে উদ্যত। বহুদিনের জাঁদরেল শত্রুকে পরাস্ত করার জয়ধ্বনি এই উদ্‌যাপন, এমনটাই তাদের অনুচ্চারিত দাবি। যদিও এতে আদৌ কোনও কাজের কাজ হয়েছে কি না সন্দেহ! আসলে এই ইভেন্ট সরকার প্রযোজিত পেশিবহুল সামরিক জাতীয়তাবাদের ভারী বুটের কুচকাওয়াজ। বাইরের এই ‘মাচো’ ইমেজ যেন বলে দিতে চায় প্রতিরক্ষা খাতে পূর্বসুরিদের দুর্বলতা।

কিন্তু এই চওড়া ছাতির পৌরুষ আজ নির্বাচনী যুদ্ধের দামামায় প্রায় নিভু নিভু। আগের বছর, সরকারের ‘অ্যান্টি ব্ল্যাক মানি ডে’-র বিপ্রতীপে আওয়াজ তুলে বিরোধী পক্ষ ৮ নভেম্বরকে তকমা দিয়েছিল ‘ব্ল্যাক ডে’ বলে। তখন অর্থমন্ত্রী তাতে ইতিবাচক স্পিন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতির ইতিহাসে এ এক সন্ধিক্ষণ! কিন্তু তারপরেও, যতই এই সরকারের ইতিবাচক স্পিনাররা ‘বিমুদ্রাকরণ’-কে বড় টার্ন পাইয়ে দিতে চেয়েছে, তা ‘দুসরা’ হয়ে মোড় নিয়েছে অন্যদিকে। বিমুদ্রাকরণকে আর কোনওভাবেই ‘দুর্নীতি’ বা ‘কালো টাকা’-র বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের তিলক পরানো যাবে না। সন্ত্রাসী তহবিল বা জালমুদ্রার বিরুদ্ধে আঘাত তো নয়ই! বরং বিমুদ্রাকরণকে এমন পদক্ষেপ রূপে খানিকটা ভাবা যেতে পারে যা অর্থনীতির ডিজিটাইজেশন চাগিয়ে দিয়েছে এবং ট্যাক্স বেস বিস্তৃত করেছে। যদিও এই দাবি পর্যবেক্ষণের অধীনে।

উদাহরণস্বরূপ– সরকারের দাবি, বিমুদ্রাকরণ ভারতকে ‘ক্যাশলেস ডিজিটাল ইকোনমি’-র দিকে এগিয়েছে। অথচ, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে অন্যকথা। ১০ অক্টোবর ২০১৮-য় নগদের সার্কুলেশন ছিল ১৯.৬৮৮ লক্ষ কোটি টাকা, যা প্রকৃতপক্ষে ৮ নভেম্বর ২০১৬-র চেয়ে ১.৭১১ লক্ষ কোটি টাকা বেশি। মাসে মাসে এটিএম থেকে তোলা নগদের পরিমাণ আগস্ট ২০১৮-য় ২.৭৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অথচ আগস্ট ২০১৬ সালে তা ছিল ২.২০ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২৫ শতাংশেরও বেশি অতিরিক্ত লাফ! এবং আগের বছরের মূল্য অর্থাৎ ৮.৮ শতাংশ থেকে ২০১৭-’১৮-র শেষদিকে ‘কারেন্সি টু জিডিপি রেশিও’ ১০.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

হ্যা, অর্থনীতির লক্ষ্য বদলেছে বটে। কিন্তু সেই লক্ষ্য এতবার বদলেছে যে, মাঝেমধ্যে তা মনে করতে গেলেই মাথা ঘোরে, আসলে ঠিক কী কারণে যে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট তুলে নেওয়ার এই নাচন নাচা হয়েছিল! সেই সময়, প্রধানমন্ত্রীকে সমাজের ‘নৈতিক পরিচ্ছন্নতা’ বিষয়ে খুব গলা ফাটাতে শোনা গিয়েছিল। তাঁর আচারনিষ্ঠ ঔদ্ধত্যে, আবেগের আপিলে লেগে ছিল গালভরা উক্তি- ‘আমাকে ৫০ দিন সময় দিন, সব কালো টাকা ফেরত আনব।’ গোয়াতে এক জনসভায় অশ্রুবিগলিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে সরানো অত সহজে যাবে না। আমাকে আপনারা জীবিত পুড়িয়ে মারলেও এই কাজ থামবে না… আর যদি এর অন্যথা হয়, আমার গলায় দড়ি!’ এ যেন এক প্রাণোচ্ছল, বুক বাজানো ও পাড়া মাতানো জননেতার ডায়ালগ!

লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন দিনের পর দিন পুরনো নোট বদলের জন্য ব্যাংকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছিল, তখনও ওই উৎকণ্ঠার মধ্যে আশার হাতছানি কিঞ্চিৎ ছিল যে- ‘না, কাজ তার মানে নিশ্চয়ই হচ্ছে।’ নাগরিকের মুখচ্ছবিতে ‘আমরা করব জয়’ মাফিক জয়গানের ছটফটানি লক্ষ করা গিয়েছিল। ছিল বিশ্বাসের এমত রেখাও- প্রধানমন্ত্রী আমাদের ‘রবিনহুড’। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও নেতাদের জব্বর শিক্ষা দিয়ে গরিবগুর্বোদের কপাল ফেরাবেন। সেই সময়ে করা দেশজোড়া অধিকাংশ ওপিনিয়ন পোলে দেখা গিয়েছিল যে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আছেন প্রধানমন্ত্রী। মাত্র একমাসের পরেই, মার্চ ২০১৭-তে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনে বিজেপি এক-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। ‘নোটবন্দি’ ম্যাজিক বুলেট হয়ে বিরোধীপক্ষকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছিল।

আজ, দুই বছর পর, যথেষ্ট পরিমাণে স্পষ্ট ও চাপা দুই ধরনেরই প্রমাণ রয়েছে যে, ‘নোটবন্দি’-কে আর নির্বাচন জেতার অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগানো যাবে না। যেখানে সরকার কিনা দাবি করেছিল, বিমুদ্রাকরণ নকশাল আন্দোলনের শিরদাঁড়া গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে তারা আজ কতখানি বলতে পারবে যে, ছত্তিশগড় নির্বাচনে কোনও নকশাল হিংস্রতার রক্তারক্তি হবে না? মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এই দুই রাজ্যে ছোট-বড় কৃষক ও ব্যবসায়ী রয়েছে। তাদের জন্য নতুন করে বিজেপিকে ঘুঁটি সাজাতে হবে। তার কারণ একটাই। সামাজিক-অর্থনৈতিক পিরামিড লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই নোটবন্দির কারণে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তই। মধ্যপ্রদেশের মান্দসৌরে পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছিল জলজ্যান্ত পাঁচ কৃষক। সেই স্মৃতির ঘা এখনও শুকোয়নি। বিমুদ্রাকরণ গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে ক্রেডিট নেটওয়ার্ক থেকে জমি কেনাবেচার মূল্যতত্ত্ব ভন্ডুল করে। বিমুদ্রাকরণ কৃষক বিক্ষোভের ট্রিগার যেন।

দেশের ক্ষুদ্র ও ছোট-মাঝারি উদ্যোগের (এমএসএমই) জন্য প্রধানমন্ত্রীর ‘বাম্পার দিওয়ালি অফার’- এক কোটি টাকা অবধি সুপার-ফাস্ট লোন। তা যেন সরকারের বাস্তবকে মেনে নেওয়ার এক বিলম্বিত স্বীকৃতি। কিন্তু তা ওই ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ টাইপ। বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটি ‘দোদোমা’-র মতো ফাটল আর ছত্রখান করে ছাড়ল সেসব মানুষকে, যারা কোনওক্রমে টিকিয়ে রেখেছিল নিজেদের। আজ মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর সেই কাজটাই চট করে করে ফেলা উচিত- ক্ষমা চাওয়া। কেন? না, নোটবন্দি দেশের জন্য ক্ষতিকারক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু তাঁর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি তা করতে পারলে তবে তো…!

পুনশ্চ প্রচারাভিযানের পথে নেতাদের সঙ্গে অফ-রেকর্ড কথোপকথন বাস্তব বোঝার জন্য মোক্ষম মাপকাঠি। মধ্যপ্রদেশের এক নেতাকে একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম– তাহলে এবারের নির্বাচনে জয়ের চাবিকাঠি কী? পকেট থেকে একখানা কড়কড়ে ২০০০ টাকার নোট বের করে তাঁর উত্তর: ‘ক্যান্ডিডেট অউর লিডার তো ম্যাটার করতে হ্যায় লেকিন… ক্যাশ কে ব্যগায়ের ইঞ্জিন নেহি চালেগি!’ টাকার প্রত্যাবর্তন ঘটছে।

(মতামত নিজস্ব)

[‘লাল’ সন্ত্রাসে ফের রক্তাক্ত ছত্তিশগড়, উগ্রপন্থীদের সমর্থন কংগ্রেসের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ