Advertisement
Advertisement
Shakti Chatterjee

শক্তির রূপান্তর, কবির জন্মদিনে স্মৃতির দু-এক পশলা

২৫ নভেম্বর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন।

Editorial on memories of Poet Shakti Chatterjee
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:November 25, 2024 4:04 pm
  • Updated:November 25, 2024 4:51 pm  

‘শক্তিসম্পদ’ যতটা কলকাতার, যতটা শান্তিনিকেতনের, ততটাই উত্তরবাংলার বুঝিবা। সেখানের অরণ্যঅঞ্চল ব্যাপকভাবে চষেছেন শক্তি চট্টোপাধ‌্যায়। তাঁর মৃত্যুর দু’দিন পর আমার কাছে পৌঁছয় শোকসংবাদটুকু। কবি-সাহিত্যিকদের প্রকৃত জন্ম যে হয় তাঁদের প্রয়াণের পর থেকেই! আজ, কবির জন্মদিনে স্মৃতির দু’-এক পশলা। লিখছেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ‌্যায়

‘বরফ, এই দ্যাখো, বরফ শুধু, এই তো শক্তি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়…’
মুঠো খুলে দেখালেন অধ্যাপকমশাই। দু’হাতেই বরফ ততক্ষণে গলে জল, ভদ্রলোকের হাতে আর ভেজা জামাকাপড়ে শুধুই কাঠের গুঁড়ো। চোখের জলে মাখামাখি, তাঁকে দেখে সহযাত্রীদের চোখও শুকনো থাকে না আর।

Advertisement

প্রসঙ্গ, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিন। কিছুটা আকস্মিকভাবেই বসন্তকালের শেষ রাতে তাঁর চলে যাওয়া। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে তাঁর মরদেহ আনা হচ্ছে কলকাতায়, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। স্মৃতিচারণা করছিলেন কবি কমল দে শিকদার, তখন বর্ধমানে উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী। সরকারের উচ্চতম মহল এবং বিখ্যাত কবিদের থেকে বার্তা আসে তাঁর কাছে, স্টেশন সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে সমন্বয় রেখে যাতে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের যাত্রাপথ সুগম রাখা হয় সেদিন; কোথাও যেন ডিটেন না করা হয়।

ট্রেন এল যথাসময়ে, কিন্তু কোন কামরায় বরফের চাঙড়ে শায়িত কবির দেহ? এসি কামরার একটি দরজা থেকে জল বেরিয়ে আসছে দেখে ঠিকঠাক আন্দাজ করা গেল।

নিত্যযাত্রী-রূপে দেখেছি, জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস আর শান্তিনিকেতন, কাছাকাছি সময়ে বর্ধমান স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। দুর্গাপুর থেকে ফেরার দিনে ওই জম্মু তাওয়াই আমারই অভ্যস্ত ট্রেন। বর্ধমান থেকে অনেক দিনই মায়ের পুরনো কলিগ বা অনুজ সহযাত্রীদের দেখা পাই, তাঁরা এখন আমার অগ্রজ বন্ধু। কবি ও কবিতা জড়িয়ে হার্দিক আড্ডার সমৃদ্ধ অবকাশ ঘটে। সেভাবেই একদিন, অধ্যাপকের বয়স যখন চল্লিশের নিচে, তখনই মার্চের সেই মনে রাখা দিনটির কথা বলছিলেন আমাদের। ট্রেনের রং সাইড দিয়ে লাফিয়ে নেমে, যে-প্ল্যাটফর্মে শান্তিনিকেতন দাঁড়িয়ে, সেখানেই একেবারে সঠিক স্থানে লাফিয়ে উঠে, মুঠো ভরে খুবলে আনলেন বরফের চাঙড় কিছুটা। আবেগ সংবরণ করে ফের লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে নিজের ট্রেনের কামরায় ফেরা বেশ কঠিন, একটা বয়সের পর সেটা আর সম্ভবও নয়–এই প্রসঙ্গ পেরিয়ে, ফিরে এসেছে শুধু কবি ও কবিতা জড়ানো আবেগ।

দার্জিলিং জেলায় পাণ্ডববর্জিত গ্রামে তখন আমার থাকা। শক্তি প্রয়াত হলেন শুক্রবার, আর রবিবার বেশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠে মাঠে হাঁটাহাঁটি করার সময়ে দূরে গ্রামবাসী একজনের হাতে আমাদেরই জন্য আনা আগের দিনের কাগজটা ক্যাজুয়ালি হাতে নিয়ে হৃৎপিণ্ড যেন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল। প্রথম পাতার ডানদিকের কলামে তাঁর ছবির তলায় লেখা: শক্তি ডাইজ আফটার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। স্নানাহার, রোজকার কাজগুলো কিছুই করতে ভাল লাগছিল না। বিরস দিন, বিরল কাজের বিকেলে, অরণ্যপথে পায়চারি করার সময়ে, আমার অসম্ভব নীরবতা দেখে সহকর্মী বোঝাতে চাইলেন, শক্তির কি বিনাশ হয় কখনও? শক্তির রূপান্তর হয় মাত্র।

আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে খিশখিশ করে চারিদিক থেকে অজস্র ঝরাপাতা, আমাদের ঘিরে ঘিরে, ঘুরে গেল তিস্তার নিঝুম চরের দিকে। দু’জনেই শিহরিত হয়ে উঠি। অতিশয়োক্তি নয় একটুও, অদ্ভুত অতিলৌকিক একটা হাসির শব্দ যেন খুব মজা করল কয়েক মুহূর্ত, আমাদের নিয়ে।

কালিঝোরার পাহাড়ে-জঙ্গলে সমস্ত শীতকাল জুড়ে সন্ধে কিছুটা গড়িয়ে গেলে, অদ্ভুত একটা শনশন হাওয়া বয়। অনেকেই জানেন। পাহাড়ের অনেক উপরে, দীপাবলি উৎসবের মতো আলোর মালা, মার্চ মাসে খুব পরিচিত দৃশ্য। শুকনো পাতায় আগুন লাগানো হয় বন দফতরের উদ্যোগে, সমস্ত গাছপালা আগামী বর্ষায় যাতে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠে। সমস্ত স্বাভাবিক বিজ্ঞানচেতনা পেরিয়ে, অতীন্দ্রিয় একরকম প্রসন্ন অনুভূতির আচ্ছন্নতা, এখনও আমার গেল না! শক্তির নানা কবিতার লাইন মনে পড়ছিল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন কবিতামালার আকস্মিক একটি পঙ্‌ক্তি: ‘জঙ্গলে জানি না কার দোষে দরজা বন্ধ হয়ে গেল/ আমার মনের চোখে খুলে দিল কত না জানালা…’ শক্তির বিভিন্ন অপ্রকাশিত কবিতা কত না কাগজে বেরিয়েছে তারপর। এলেবেলে একটা অসমাপ্ত কবিতা, মনে পড়ে, কারণ কালিঝোরাতে বসে লেখা। কাগজটার পিছনে পিকনিকের হিসেবনিকেশ ছিল।

পূর্ত দপ্তরের আদি সেই বাংলোটা, যেটা বাঁক ঘুরে উঠতেই চোখে পড়ে, ‘অনুসন্ধান’ সিনেমায় দেখা গিয়েছে বলে অনেকে চেনে। ক্রমে, অনুভব করি, ডুয়ার্স অরণ্য মন দিয়ে ঘুরে দেখলে, শক্তির প্রচুর কবিতার সমীকরণ বুঝতে সুবিধা হয়। তাঁরই কথায়: ফুলের মতন সহজ হয়ে আসে তোমায় কিছু বলার মত ভাষা… দরোজা নেই, জানালা নেই তাতে… বহুল প্রচারিত তথ্য, উত্তরবঙ্গের অরণ্যঅঞ্চল ব্যাপক চষেছেন শক্তি, তাঁর একই জন্মদিনের সঙ্গী কবি অমিতাভ দাশগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে। কাব্যকৃতি কি সৃজনকাজের ক্রিটিকাল পর্যালোচনার বদলে বেশি করে শোনা যায় তাঁদের জীবনযাপনের নানাবিধ অ্যাডভেঞ্চার, এখনকার প্রজন্ম অবশ্য ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে সেসব শুনতে-শুনতে। অনেকেই বুঝে গিয়েছে, সবটাই যেন ছিল ভাবমূর্তি সৃজনের একরকম কায়দা; বাণিজ্য উসকে দেওয়ার কৌশল। সেই চক্কর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েই কি শক্তির সামগ্রিক পাগলামি?
প্রয়াণকথায় আরম্ভ করে জন্মদিনে পৌঁছতে চাইছি ঠিক এজন্যই। কবি-সাহিত্যিকদের প্রকৃত জন্ম যে হয় তাঁদের প্রয়াণের পর থেকেই, সেখানে কারও কোনও নির্বাসন নেই! বসন্তের অরণ্য, বিষণ্ণতাকে প্রশ্রয় দেয় না কখনও। সহসা সেই বনমর্মরে, বাতাসের শব্দে মনে পড়ে, ত্যাগে আমার ভাগ বসেছে, এই বসন্তে বৃষ্টি হবে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক জীবন্ত স্মৃতি, সেসব নানাভাবে বারংবার বলাই যায়, বলি আমরা অনেকেই। কিন্তু ওই পাহাড়ে-জঙ্গলে, একলা একা আমার একটি বেলার শোক, শান্ত হয়ে এসেছিল দিনে দিনে, আবারও অরণ্যে যেতে যেতে। কলকাতায়, শান্তিনিকেতনে যেভাবে আছেন তিনি, ঠিক সেভাবেই উত্তরবাংলাতেও আছেন। কালিঝোরায় গিয়েছি তো তারপর কতবারই। শিলিগুড়ি থেকে সিকিম কি কালিম্পং যাওয়ার প্রধান পথ তো ওটাই। বাঁধ তৈরি হয়েছে, গাছপালায় ধুলোর আস্তরণ, দোকানপাট বেড়েছে অনেক।

তবুও, ভুলতে পারব না সেই মার্চ-শেষের পঁাচ মাস পর ঘোর বর্ষায় একবার গিয়ে থাকার অভিজ্ঞতা। হঠাৎ করে অনেকখানি বেড়ে ওঠা ঘন সবুজ সমস্ত গাছপালা যেন হাসছে, আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। খিশখিশ শব্দে সেই পাতা ঝরানো অপরাহ্ন কি সেই গানটাই মনে করিয়ে দেয় না– আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে/ ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে।’

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement