Advertisement
Advertisement

Breaking News

MS Subbulakshmi

খ্যাতি, বিড়ম্বনা এবং এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মী

পৃথিবী জুড়ে অনুষ্ঠান করেছেন যিনি, কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে যাঁর নাম সমার্থক।

Editorial on Myths and misconceptions around MS Subbulakshmi
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:September 23, 2024 5:21 pm
  • Updated:September 24, 2024 2:39 pm

কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে সমার্থক ভাবা হয় এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীকে। কিন্তু তিনি সমালোচিত হন এই মর্মে যে, এই ঘরানার যা মূলাধার ও আস্বাদ্য, তা তিনি সেভাবে অনুসরণ করেননি। সম্প্রতি বাহিত হল তাঁর জন্মদিন। লিখছেন ভাস্কর মজুমদার

 

Advertisement

বাড়ির পাশের ‘সংগীত রিসার্চ অ‌্যাকাডেমি’-তে শীতকালীন বার্ষিক সংগীত সম্মেলনের পোস্টার পড়েছে। দেশের নানা প্রান্তের শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীদের গানবাজনা শোনা যাবে, তা-ও বিনামূল্যে। হিন্দুস্তানি শিল্পীদের পাশাপাশি সংযোজিত হয়েছে কর্নাটকী শিল্পীদের নামও। যে-সময়ের কথা বলছি, মনে আছে, সেবার কর্নাটকী শিল্পীদের মধ্যে সুধা রঘুনাথনের আসার কথা।

তা, নেটে তাঁর সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করলাম। ইউটিউবে খুঁজলাম তাঁর গান। প্রথম যে-গানটি পেলাম, তা ‘ভাবয়ামি গোপালবালং’। অন্নামাচার্য লিখিত এই গান ভক্তিভাবের পরাকাষ্ঠা। শিশুকৃষ্ণের পায়ের নুপূর শুনে কবি বিভোর হয়ে যাচ্ছেন– এরকম গানের কথা। সুধা রঘুনাথন গানটি গেয়েওছেন অপূর্ব। এটির আর-একটি সংস্করণে বম্বে জয়শ্রী আরও মধু ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু সুরের চরমতম সার্থকতায় এ-গানের অন্তরে একজনই পেরেছিলেন প্রবেশ করতে– সুরসম্রাজ্ঞী এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মী (তামিলরা বলেন ‘কুঞ্জাম্মা’)।

মাদুরাইকে তখন বলা হত ‘থুঙ্গা নগরম’, অর্থাৎ যে-শহর কখনও ঘুময় না। এত দ্রুতগতির জীবনযাত্রা এ-শহরের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, মানুষ সেখানে ব্যস্ততা ছাড়া থাকতে পারত না। সংস্কৃতি ছিল মাদুরাইয়ের প্রাণভোমরা। সঙ্গে আড়াইহাজার বছরের ইতিহাস ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বাণিজ্যে এগিয়ে যাচ্ছে মাদুরাই। অর্থনীতি মজবুত হচ্ছে। এদিকে, ভারতে স্বাধীনতার স্বর ধীরে-ধীরে জোরালো হওয়া শুরু হয়েছে। এইরকম সময়, বীণাবাদিকা সন্মুখাভাদিভর আম্মালের কন্যাটি, সকালে উঠে স্নান সেরেই তানপুরায় তান তুলত। তারপর সেই যে তানপুরা ছেড়ে ‘সা’-তে গলা লাগাল, তারপর ঘরময় ঘুরে বেড়াল, গান গাইল; আবার যখন তানপুরার কাছে ফিরল হয়তো কয়েক ঘণ্টা পরে, তানপুরার
‘সা’-তে পুনরায় গলা মিলিয়ে অনুভব করল– সুরের একবিন্দুও নড়চড় হয়নি! আগামী জীবনেও কখনওই সুর নড়ে যাওয়া তো দূরের কথা, একচিলতে এধার-ওধার হয়েছে, সে-কথা তঁার কঠিনতম সমালোচকও বলতে পারবে না।

এগারো বছর বয়সে তিরুচিরাপল্লির রকফোর্ট মন্দিরে প্রথম অনুষ্ঠান। ১৯২৭। ঠিক দু’-বছর পর মাদ্রাজ মিউজিক আকাদেমিতে শিল্পী-রূপে তার আত্মপ্রকাশ। সুব্বু তার মায়ের পরিচয়েই নিজের নাম গড়ে তোলে– মাদুরাই সন্মুখাভাদিভর সুব্বুলক্ষ্মী। এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মী। সেবার আকাদেমি তার কঠিন নিয়ম-নিগড়ের মধ্যেও একটি মেয়েকে সুযোগ দিয়েছিল। তামিল দুনিয়ার তাবড় সংগীতশিল্পী ও সমালোচক বিস্মিত হয়েছিল সুব্বুলক্ষ্মীর সুনিপুণ কণ্ঠশিল্পে। পরে সারা ভারতে সুরে-টলটল কণ্ঠস্বরের ‘আদর্শ’ হয়ে উঠবেন এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মী। বড়ে গুলাম আলি খঁা সাহেব, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, কিশোরী আমোনকার, উস্তাদ বিসমিল্লা খঁা, এমনকী লতা মঙ্গেশকর– প্রত্যেকেই এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন। কেউ কেউ এখনও বলেন– সাত-সুরের উপরে যদি ঐশ্বরিক অষ্টম সুর কিছু থাকে, তা সুব্বুলক্ষ্মীর কণ্ঠেই ধরা দিত!

পৃথিবী জুড়ে অনুষ্ঠান করেছেন যিনি, কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে যাঁর নাম সমার্থক, দেশের সমস্ত পদ্মসম্মান-সহ (পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ) ভারতরত্ন যিনি পেয়েছেন, যিনি পেয়েছেন মাদ্রাজ আকাদেমির ‘সংগীত-কলানিধি’ পুরস্কার, ‘সংগীত নাটক অ‌্যাকাডেমি’ পুরস্কার এবং ফেলোশিপ, এমনকী, ম্যাগসেসে পর্যন্ত– তাঁর জীবন প্রশ্নহীন প্রণাম ও ভক্তির বিগ্রহ ছিল, তা মনে করার কিন্তু কারণ নেই। চিরকাল তঁাকে তীব্র নিন্দা ও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কতটা তীব্র ছিল সেসব? এতটাই যে, এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর যে সংগীতসাধিকা-অবয়ব, তা অনেকাংশেই চুরমার হয়েছে।

মাদ্রাজের (চেন্নাই) কয়েকটি গোষ্ঠী সুস্পষ্টভাবে বলত– কর্নাটকী সংগীতের সঙ্গে এই যে এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর সমার্থক হয়ে যাওয়ার ছবি, তা বিজ্ঞাপনী ধোঁকা, মানুষকে বোকা বানানোর জন্য। কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতের মূলাধার ছোট-ছোট ভক্তিগীতি নয়, যা সুব্বুলক্ষ্মী আজীবন গেয়েছেন। কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীত একটি খুবই গম্ভীর, কঠিন শাস্ত্র-নির্ভর অনুশীলন ও সুরপথ। এর মূলকথা ‘রাগম-তানম-পল্লবী’; যা এম. এস. দু’-একবার ছাড়া কখনও করেননি। যেসব গান দিয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা নিরূপিত হয়, কর্নাটকী শাস্ত্রের নিরিখে সেগুলোকে চটুল বলা চলে। সুব্বুলক্ষ্মীর সুরেলা কণ্ঠস্বরের জুড়ি ছিল না। কিন্তু সেই সুর, সেই নিখুঁত আবেদন ধরে রাখতে গিয়ে উনি যেটা করতেন– অর্থাৎ ‘রিহার্সাল’– সেটা কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতে নিচু চোখে দেখা হয়। ওই শাস্ত্রানুসারে, শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গতকারদের দেখা হবে একেবারে মঞ্চে। যুগলবন্দিতে যা বেরিয়ে আসবে, তা-ই হবে, শুদ্ধ সংগীত। এখানে আগে থেকে কিছু করে রাখা যায় না।

অথচ, সুব্বুলক্ষ্মী এমনটাই করতেন। তা এতখানি নিখুঁত হত যে একসময় তিনটে স্বর প্রযুক্ত হয়ে একটা ‘কম্পাউন্ড’ তৈরি হত। একটা স্বর থাকত সুব্বুলক্ষ্মীর, সঙ্গে তাঁর সৎ-কন্যা রাধা বিশ্বনাথনের ‘ভোকাল সাপোর্ট’, আর সেই সঙ্গে ভি. ভি. সুব্রহ্মণ‌্যমের ভায়োলিন।

সবশেষে যে-অভিযোগ প্রায়ই উঠে আসত, তা হল, সুব্বুলক্ষ্মীর স্বামী টি. সদাশিবমের কার্যকলাপ সংক্রান্ত। এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর জনপ্রিয়তার টি. সদাশিবম নিজ-হাতে গড়ে তুলেছিলেন। আবার এ-ও সত্য, মাদুরাইয়ের বাড়ি থেকে পালিয়ে বছর কুড়ির সুব্বুর মাদ্রাজে বিবাহিত ও দু’-সন্তানের জনক সদাশিবমের বাড়িতে গিয়ে ওঠা, এবং প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুতে সুব্বুলক্ষ্মীকে সদাশিবমের বিয়ে করা– তামিলনাড়ুর কোনও কোনও বৃত্তে সে-সময় নিন্দার ঝড় তুলেছিল। তবে, সদাশিবমের প্রখর বিজ্ঞাপনী বুদ্ধি এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর একটি পবিত্র ‘ইমেজ’ তৈরি করে, যে-‘ইমেজ’ সংগীতসাধিকার। সুব্বুলক্ষ্মী তঁাদের প্রাসাদোপম ‘কল্কি হাউস’-এ নাকি একশোরও বেশি সংগীতানুষ্ঠান করেছেন, এবং সেসব শুনতে আসতেন দেশের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ এবং সমাজের অন্যান্য ‘এলিট’ মানুষেরা। টি. সদাশিবম ছিলেন সি. রাজাগোপালাচারীর শিষ্যপ্রতিম। সদাশিবম সম্পাদিত ‘কল্কি’ সংবাদপত্র ছিল তখনকার তামিলনাড়ুর প্রভাবশালী পত্রিকা। এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর শেষ অভিনীত সিনেমা হিন্দি ‘মীরাবাই’-এর প্রথম শো-তে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সরোজিনী নাইডু, ইন্দিরা গান্ধী-সহ রাজনীতির বৃত্তের অনেক কেষ্টবিষ্টু হাজির ছিলেন।

তবে ‘মীরাবাই’-এর পর তিনি সিনেমায় আর থাকেননি। এমনকী, এরপরের এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মী অনেকটাই আলাদা। তিনি আর ম্যাগি-হাতা ব্লাউজ পরেননি। বিনুনিতে তঁাকে আর দেখা যায়নি। ভারী শাড়ি, ফুল-জড়ানো খোঁপা, নাকের দু’-পাটায় হিরের নাকছাবি– এম. এসের ফ্যাশনের ট্রেডমার্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এবং ওঁর ফ্যাশন যেভাবে দক্ষিণ ভারতীয় সাধারণ মানুষ (বিশেষত মেয়েরা) নকল করেছে, তেমন বোধহয় ওঁর সমসময়ের ভারতে আর মাত্র দু’জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে– কিশোরকুমার আর গীতা দত্ত। এখনও এক বিশেষ পরতের নীল রংকে দক্ষিণ ভারত ‘এম. এস. ব্লু’ বলে চেনে!

এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মী কেরিয়ারের গোড়ার দিন থেকেই প্রচারের যে আলো পেয়েছিলেন, তা কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রায় কেউ-ই এমনভাবে পাননি বলা চলে। তবে সুব্বুলক্ষ্মী কোন কনসার্টে কী গাইবেন, তা ঠিক করে দিতেন টি. সদাশিবম। সুব্বুলক্ষ্মী নাকি অন্য কিছু গাইতে চাইলেও দর্শকাসন থেকে সদাশিবমের ‘সাজেশন’ আসত– কোন রাগ, কোন গান শ্রোতার কাছে জমবে ভাল– সেই মর্মে। প্রথম নারী-শিল্পী রূপে মাদ্রাজ আকাদেমিতে সুযোগ পাওয়া, প্রথম নারী-শিল্পী রূপে ‘ভারতরত্ন’ পাওয়া এম. এস, সুব্বুলক্ষ্মী কিন্তু ‘নারীবাদী রোল মডেল’ হতে পারেননি কখনও। স্বামীর কথা মেনে-চলা একজন অনুগত স্ত্রী হয়ে ওঠার চেষ্টায় ফঁাকিও দেননি বলা চলে। তাই টি. সদাশিবমের মৃত্যুর পর আর কখনও কোনও সংগীত সম্মেলনে যোগ দেননি তিনি।

এতদ্‌সত্ত্বেও এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর সংগীতের যে-আবেদন তা কি খাটো হয়ে যায়? কখনওই নয়। খ্যাতির মধ্যগগনে দিলীপ রায়ের কাছে গান শিখেছেন; তাঁর কণ্ঠে ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। সিদ্ধেশ্বরী দেবীর থেকে কিছু ঠুমরি শিখেছিলেন, আবার বেগম আখতারের কাছে শিখেছিলেন গজল, একটি মাত্র হলেও। রবীন্দ্রসংগীতও গেয়েছেন। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত চেয়েছিল– একজন এমন সুরসম্রাজ্ঞীকে– যাঁর ‘সাধিকা’ অবয়ব থাকবে, এবং ‘ভজগোবিন্দম্‌’ রেকর্ডিং প্রকাশিত হওয়ার পরে সেই ইমেজে আরও পরিপুষ্ট হয়। সমালোচনা সত্ত্বেও এই কথা বলতে হবে যে, কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সংগীতকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে তাঁর অবদান সর্বতোভাবে অনস্বীকার্য।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক
[email protected]

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement