Advertisement
Advertisement

Breaking News

অন্ধ সাজলে প্রলয় বন্ধ থাকে না

কেরলের বন্যা নিয়ে মাধব গাডগিল কমিটি এ বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছিল আগেই। কিন্তু কে শোনে?

Experts warned of Flood fury in Kerala
Published by: Subhamay Mandal
  • Posted:August 22, 2018 2:39 pm
  • Updated:August 22, 2018 2:39 pm

শবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের অনুপ্রবেশ যদি ‘নিষিদ্ধ’ও করা যায় নতুন করে, তাহলেও কি পশ্চিমঘাট পর্বতমালা লাগোয়া রাজ্যগুলি ভবিষ্যৎ-বন্যার ভ্রুকুটি থেকে বাঁচতে পারবে? প্রকৃতিকে বঞ্চিত করে দেদার অবৈধ পাথর খাদান, রিসর্ট নির্মাণ করার ধৃষ্টতা প্রকৃতি হাতেনাতে গুনেবুঝে নিয়েছে। কেরল ভেসেছে অভূতপূর্ব বন্যায়। মাধব গাডগিল কমিটি এ বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছিল আগেই। কিন্তু কে শোনে? কলম ধরছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। 

 

Advertisement

বেজায় লোক হাসিয়েছেন রিজার্ভ ব্যাংকের সদ্যনিযুক্ত ডিরেক্টর স্বামীনাথন গুরুমূর্তি। বলেছেন, শবরীমালা মন্দিরের দেবতা রুষ্ট হয়েছেন বলেই কেরলে এই বিপর্যয় কি না সুপ্রিম কোর্ট তা ভেবে দেখুক! একই সময়ে ভিন্ন কথা বলেছেন ৭৬ বছরের পরিবেশবিদ মাধব ধনঞ্জয় গাডগিল। ক্রোধ ও ক্ষোভ না লুকিয়ে প্রবল হতাশগ্রস্ত এই অতিপরিচিত পরিবেশবিদ বলেই দিয়েছেন, কেরলে যা হয়েছে তা মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়। তাঁর কথায়, ‘ম্যান মেড ট্র্যাজেডি’। কেরলে বন্যা ও এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে শবরীমালার দেবতা আয়াপ্পানের কী সম্পর্ক? খুব সংক্ষেপে একটু বলে রাখি। কেরলে পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় চার হাজার ফুট উঁচুতে গহিন বনে শবরীমালা মন্দির। শিব ও বিষ্ণুর নারী অবতার মোহিনীর সন্তান এই আয়াপ্পান সমৃদ্ধির দেবতা। ২৭ বছর আগেও নারীরা এই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু কঠিন পাহাড়ি চড়াই-উতরাই নারীদের পক্ষে শ্রমসাপেক্ষ বলে পুরুষের তুলনায় নারী পুণ্যার্থীদের সংখ্যা সবসময়েই কম। ১৯৯১ সালে কেরল হাই কোর্টের দুই বিচারপতি কে. পরিপূর্ণম এবং বালনারায়ণ ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সি নারীদের মন্দিরে প্রবেশ ‘নিষিদ্ধ’ করে দেন। যুক্তি, ঋতুমতী নারীরা ‘অপবিত্র’। তাঁদের প্রবেশ দেবতাকে রুষ্ট করে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। চলতি বছরে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, কোনও মন্দিরে পুরুষের প্রবেশের অধিকার থাকলে নারীদেরও তা থাকবে। সংবিধান কোনও বৈষম্য মান্যতা দেয় না। নারীর ঋতুমতী হওয়া ঈশ্বর অথবা প্রকৃতির দান। এটা বৈষম্যের অজুহাত হতে পারে না। ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’-র আদর্শে লালিত স্বামীনাথন গুরুমূর্তি একা নন। তামিলনাড়ুর উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ‘হিন্দু মাকাল কাটচি’-ও গুরুমূর্তির সুরে সুর মিলিয়ে বলেছে, ঋতুমতী নারীর সংস্রব দেবতার অপছন্দ। রাজ্যের প্লাবন সেই প্রতিবাদের একটা রূপ। দলের এক নেতা রামেশ্বরম মন্দিরে পুজো দিয়ে বলেছেন, কেরল সরকারের উচিত অবিলম্বে বিধানসভায় প্রস্তাব পাস করিয়ে শবরীমালায় নারীপ্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া।

Advertisement

[আমিরশাহীর দেওয়া ৭০০ কোটির সাহায্য নিতে ‘নারাজ’ কেন্দ্র]

সুখের কথা, গুরুমূর্তিদের মতো ‘মান্যগণ্য’দের এহেন বালখিল্য উদ্গার মাধব ধনঞ্জয় গাডগিলের মতো পরিবেশবিদের কণ্ঠস্বরকে চাপা দিতে পারেনি। পারেনি বলেই আজ মাধব শুধু মহা চর্চিতই নন, তাঁর মতো ‘গেঁয়ো যোগী’, যিনি পশ্চিমঘাটের পশ্চিম প্রান্তের রাজ্যগুলির ধিক্কার ও ছিছিক্কারে জর্জরিত হয়েছিলেন, আজ নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন। প্রমাণ করে দিলেন, একদা যে-আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন, সাত বছর পর আজ তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত। বিপর্যয়ের পর মাধব ধনঞ্জয় গাডগিল বলেছেন, এখন অন্তত তাঁর সুপারিশ সরকার মেনে নিক যাতে ভবিষ্যতে প্রকৃতির রোষ থেকে বাঁচা যায়। মাধব গাডগিলের কথা একটু বলি। পুণের এই প্রকৃতিপ্রেমী পরিবেশবিশারদকে ২০১০ সালে ভারত সরকার দায়িত্ব দেয়, পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে সুরক্ষিত রাখতে সংরক্ষণের স্বার্থে কী কী করা উচিত তা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট পেশ করতে। পরিবেশবন্ধুদের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার এই কমিটি গঠনে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, কেরল থেকে গুজরাত পর্যন্ত বিস্তৃত গোটা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশ নগরায়ন ও উন্নয়নের নামে নয়ছয় হচ্ছিল। দেদার ও মাত্রাছাড়া পাথর ​খাদান, পর্যটনের দোহাই দিয়ে নিত্য পাহাড় কেটে রিসর্ট তৈরি, নদীগুলির দু’ধার দখল করে উচ্চবিত্তদের জন্য খামারবাড়ি তৈরি, বনাঞ্চল সাবাড় হয়ে যাওয়া– এসব বন্ধে কী করা দরকার, সরকার সেটাই জানতে চেয়েছিল ‘গাডগিল কমিটি’-র কাছে। ২০১১ সালে মাধব গাডগিল রিপোর্ট জমা দেন। তাঁর সুপারিশ দেখে শুধু কেরলই নয়, পশ্চিমঘাটের পশ্চিমের রাজ্যগুলির প্রত্যেকেই হাঁ হাঁ করে ওঠে। গ্যাডগিল বলেছিলেন, সহস্রাধিক পাথর খাদানের মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ১৫০টির। অবৈধগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। বন্যাপ্লাবিত নদীগুলোর জল যতদূর পর্যন্ত যায়, ইংরেজিতে যাকে ‘ফ্লাড প্লেন’ বলে, পলি-জমা যে বিস্তৃত অঞ্চলে সাধারণত চাষ হয়, তা দখল করে ভূমি মাফিয়ারা ‘রিভার ফ্রন্ট প্লট’ তৈরি করে বেচে দিয়েছে। গ্যাডগিল কমিটি বলেছিল, এই প্রবণতা বন্ধ না হলে বিপর্যয় অবধারিত। গোটা পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন কোন অঞ্চল কতটা স্পর্শকাতর, কোথায় কোনওরকম আঁচড় কাটা যাবে না। কোথায় কিছু একটা করতে গেলে আগে নিতে হবে পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র।

[বন্যা দুর্গতদের জন্য পিঠ পেতে যুবক, ভাইরাল কেরলের ভিডিও]

কেরল, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাত ও তামিলনাড়ু সবাই গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ মানতে অস্বীকার করে। মাফিয়াদের চাপে রাজনৈতিক দলগুলো তুলে ধরে উন্নয়ন বনাম পরিবেশের চিরন্তন দ্বন্দ্বকে। কেন্দ্রীয় সরকার তড়িঘড়ি গঠন করে আর একটা কমিটি। ‘ইসরো’-র ডিরেক্টর কৃষ্ণস্বামী কস্তুরীরঙ্গনকে বাছা হয়। তাঁকে বলা হয় গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ খতিয়ে দেখে মতামত দিতে। কস্তুরীরঙ্গন কমিটি গ্যাডগিলের বেছে দেওয়া স্পর্শকাতর এলাকাগুলো দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেয়। অনেক ছাড় দিয়ে যে সুপারিশ পেশ করা হয়, রাজ্যগুলো সেটাও অগ্রাহ্য করে। এখন দেখা যাচ্ছে, মাধব গ্যাডগিল যে-জেলাগুলোর ক্ষেত্রে বেশি জোর দিয়েছিলেন, পাথর খাদান পুরোপুরি বন্ধের সুপারিশ করেছিলেন, পাহাড়ের পাদদেশে গাছ কেটে বসতি বন্ধের কথা বলেছিলেন, স্থানীয় নদীগুলোর ‘ফ্লাড প্লেন’ খালি করার কথা বলেছিলেন, সেখানেই ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কোচি বিমানবন্দর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়েছে, অতীতে কোনও দিন ঘটেনি! ক্ষোভে-দুঃখে বিরলকেশ মাথা খামচে মাধব গ্যাডগিল তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ইটস নাথিং বাট ম্যান মেড ট্র্যাজেডি’।

ফি বছর ভারতে প্রথম বর্ষা নামে কেরলেই। পশ্চিমঘাট পর্বতমালাই এর একমাত্র কারণ। তারপর ক্রমে ক্রমে সেই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কেরলে বর্ষা মানেই মুষলধারে বৃষ্টি। ঈশ্বরের আপন দেশে সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। রাজ্যে বড় বাঁধের সংখ্যা মোট ছ’টি। ছোট ছোট জলাধার আরও কিছু। পশ্চিমঘাট থেকে বের হয়ে আরব সাগরে পড়েছে বেশ কয়েকটি ছোট-মাঝারি নদী। ইদামালায়া ও ইডুক্কি জলাধারের ক্ষমতা এক বিলিয়ন কিউবিক মিটারেরও বেশি। এই রাজ্যে প্রতি বছরেই স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টি বেশি হয়। কিন্তু গত একশো বছরের ইতিহাসে যা ঘটেনি, এবার তা ঘটল। বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৪৬ শতাংশ বেশি। আগস্ট মাসের ৯ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত অবিরাম ধারাপাত ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেয়। ওই সাতদিনে কোল্লাম জেলায় বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়েও ৫২৭ মিলিমিটার বেশি, ইডুক্কি জেলায় ৪৩৮ মিলিমিটার এবং মালাপ্পুরমে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৯৯ মিলিমিটার অতিরিক্ত। অবস্থা যে এমন হবে তার কোনও আন্দাজ কারও ছিল না।

[বন্যা দুর্গতদের দিকে বিস্কুট ছুড়ে বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই, ভাইরাল ভিডিও]

প্রতি বছর রাজ্যের বড়-ছোট সব জলাধার জুলাই নাগাদ অর্ধেক বোঝাই হয়ে যায়। আগস্ট মাসে বর্ষাবিদায়ের সময় সব জলাধার মোটামুটিভাবে ৯০ থেকে ৯৮ শতাংশ পূর্ণ থাকে। সেচের জন্য এ এক মধুর সংবাদ! এবার আগস্টের গোড়াতেই জলাধারগুলো উপচে ওঠে। বন্যা ঠেকাতে বাঁধ থেকে যে জল ছাড়া জরুরি, সেই বোধের উদয় কোনও অজ্ঞাত কারণে এবার হয়নি। ৯ আগস্ট থেকে প্রবল বর্ষণ শুরু হলে বাঁধ বাঁচাতে জল ছাড়তে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। সেই জলধারণের ক্ষমতা আগেই প্লাবিত নদীগুলোর ছিল না। এতে ক্ষতি হয় ‘ফ্লাড প্লেন’-এ গড়ে ওঠা বসতির। কেরলের ম্যাপটা মনে করুন। একটা ফালি দিয়ে উঠে গিয়েছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। লম্বায় কেরল ৫৮০ কিলোমিটার হলেও চওড়ায় অত্যন্ত কম। পশ্চিমঘাট থেকে আরব সাগর পর্যন্ত চওড়া কোথাও ১১ কিলোমিটার, কোথাও ১২১ কিলোমিটার। একে আকাশভাঙা বৃষ্টি, তার ওপর বাঁধ-নিঃসৃত জলের তোড় স্তিমিত করার জন্য যে বিপুল এলাকা প্রয়োজন, ভৌগোলিক কারণে কেরলের তা নেই। ওই প্রবল জলরাশির তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যায় জনপদ। গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে ওঠে ভূমিধস। নির্বিচারে বন সাফ ও যত্রতত্র পাথর খাদান কী কেলেঙ্কারি ডেকে আনতে পারে কেরলের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা তার উদাহরণ হয়ে থাকল। যত মানুষ ভেসে গিয়েছেন, তার অর্ধেক ভূমিধসের শিকার। পশ্চিমঘাটে এমন ধ্বংস আগে দৃশ্যমান ছিল না।

গঙ্গাকে ধারণ করেছিলেন মহাদেব তাঁর জটায়। সেই জটা যে হিমালয়ের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল স্বামীনাথন গুরুমূর্তিদের তা অজানা নয়। ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ে ছ’হাজার মানুষের প্রাণ কেন গিয়েছিল অজানা থাকার কথা নয় তা-ও। পশ্চিমঘাটের পাহাড় ও বনাঞ্চল তার প্রতি অবিরাম অত্যাচারের জবাব যেভাবে দিল, তাতে গুরুমূর্তিদের জ্ঞানচক্ষু না খুললে সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। ইতিমধ্যেই বিপদঘন্টি বাজিয়েছেন পরিবেশবিদেরা। গোয়া ও কর্নাটককে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এরপরেও রাজ্য সরকারগুলো উটপাখি সেজে থাকলে মাধব ধনঞ্জয় গাডগিলদের মতো আমরাও কপাল চাপড়ে হা-হুতাশ করে যাব।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ