সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রতিশ্রুতি ছিল ক্ষমতায় এলে মধ্যপ্রদেশে কৃষকদের ঋণ মকুব করা হবে। নব্য কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ দু’লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ মকুব করে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করেছেন। কিন্তু কৃষিঋণ মকুব করলেই কি চাষিদের সমস্যার মূলে উপনীত হওয়া যাবে? রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের মতে, এটা কোনও সমাধানই নয়। কৃষিঋণ মকুবের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যেন ‘নিষিদ্ধ’ করে দেওয়া হয় এই মর্মে তিনি চিঠিও লিখেছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে।
শপথগ্রহণের ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই মধ্যপ্রদেশের নতুন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ প্রতিশ্রুতি পালন করলেন। দু’লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া কৃষিঋণ তিনি মকুব করে দিলেন। পায়ের নিচের জমি শক্ত হওয়ায় উৎফুল্ল রাহুল গান্ধী টুইট করলেন, ‘সিএম মধ্যপ্রদেশ ওয়েভস ফার্ম লোনস। ওয়ান ডান, টু টু গো।’ রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট ও ছত্তিশগড়ের নতুন কান্ডারি ভূপেশ বাঘেল আজ অথবা কাল একইভাবে তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিও পালন করবেন। কথা দিয়ে কথা সবসময় রাখা যায় না। অনেকে রাখেও না। তবে এবার কথা রাখা বড় দায়। না হলে চারমাস পর লোকসভা ভোটে ঘাড়ে কোপ পড়তে পারে!
এটা যদি একটা চিত্র হয়, অন্যটার ক্যানভাস তাহলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু দুটো ছবিই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। দিল্লির বাজারে পিঁয়াজের দাম ২০ টাকার নিচে নামছে না। অথচ প্রায় প্রতিদিনই খবর আসছে, নাসিকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাইকারি পিঁয়াজ বাজার লাসালগাঁওয়ে পিঁয়াজের দাম কেজি প্রতি দু’টাকায় নেমে গিয়েছে। অনেক সময় ওই দামেও বিকোচ্ছে না। রসুনের দাম হয়েছে আট আনা কেজি! চাষিদের মাথায় হাত। ফসল নিয়ে মান্ডি যাওয়া-আসার ভাড়াও উঠছে না। অনেকে খেতের পিঁয়াজ-রসুন খেতেই রেখে দিচ্ছে। কেউ কেউ দাম না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। পাইকারেরা বলছে, এবার বাম্পার ফসল হয়েছে। আগেরবারের মজুত পিঁয়াজ বাজারে ছাড়তে হচ্ছে সস্তায়। ভাঁড়ার খালি না করলে নতুন পিঁয়াজ ঢোকানো যাবে না। সব মিলে এবার দামের দফারফা। চাষির মাথায় দুশ্চিন্তার বোঝা।
দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাগজের খবর তো অন্যরকম। মান্ডিতে চাষি দাম পাচ্ছে না। অথচ খুচরো বাজারে বিশ টাকা?’ গম্ভীর মুখে দোকানির জবাব শুনলাম, ‘আমিও ছোট থেকে এই দেখে-শুনে বড় হলাম। চাষি কোনওকালেই দর পায় না। অভাবী দালালও কেউ দেখেনি।’
এটা কোনও খণ্ডচিত্র নয়। কখনও পিঁয়াজ-রসুন, কখনও আলু-আপেল, কখনও বা ধান-গম-আখ-তুলো, বছর বছর চাষির ঘরে এই সংকট ঘুরে-ফিরে আসে। দাম না পেয়ে চাষি আত্মহত্যা করে। দেনায় সর্বস্বান্ত হয়। বাঁচার তাগিদে চাষিরা মিছিল করে। আন্দোলনে নামে। ভোটের ভয়ে সরকার সচেষ্ট হয়। বিরোধীরা চাপ বাড়ায়। কৃষিঋণ মকুব ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলে। কখনও পারে, কখনও নয়। গো-বলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপিকে পথে বসানোর অন্যতম প্রধান কংগ্রেসি-অস্ত্র ছিল: এই ঋণ মকুব। সেই অস্ত্রে বিজেপি আপাতত ঘায়েল।
বিজেপি অবশ্য ইতিমধ্যে কমলনাথের সিদ্ধান্তে কিছু ফাঁকফোকর খুঁজে পেয়েছে। কমলনাথ ঋণ মকুব করেছেন দু’লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু মকুব করা হবে তাদের, যারা এই বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কর্জ নিয়েছে। কোন চাষির ঋণ মাফ হবে আর কার
হবে না, তা ঠিক করার একটা পদ্ধতি থাকবে। সেটা কী, কমলনাথ প্রথমদিন তা স্পষ্ট করেননি।
বিজেপি এটাকেই এক ধরনের কৌশল, কারচুপি বলে আসর গরমের চেষ্টা করছে। এই সেদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন গৌরীশঙ্কর বিষেণ। তাঁর প্রশ্ন, ঋণ মকুব কেন ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হচ্ছে না? কেন শুধু ৩১ মার্চ পর্যন্ত? প্রচারে এসে রাহুল গান্ধী তো সব ‘অনাদায়ী’ ঋণ মকুবের কথা বলেছিলেন? তাহলে মকুবই বা কেন মাত্র দু’লাখ পর্যন্ত? বেশ বোঝা যাচ্ছে, নতুন সরকার এই ফাঁকফোকর না-বোজালে লোকসভা ভোটে এটা নিয়েই হুড়ুমতাল শুরু হবে। ঋণ মকুবের এই প্রতিযোগিতায় অসমের বিজেপি সরকারও এগিয়ে এসেছে। লোকসভা ভোটের আগে কৃষক ক্ষোভ ঠেকাতে সর্বানন্দ সোনোয়াল ঋণের সিকি শতাংশ মকুব করেছেন। তবে মকুব-অর্থের পরিমাণ বেঁধে দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। পাশাপাশি বলেছেন, সুদের হারে সরকার চার শতাংশ ছাড় দেবে। এর মানে, সরকারের দাবি: চাষি কৃষিঋণ পাবে বিনা সুদে।
কৃষিঋণ মকুবের এই প্রতিযোগিতার মাঝে বেসুরো গেয়েছেন রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। তিনি বলেছেন, চাষিরা সমস্যায় আছে। কিন্তু ঋণ মকুব ও ফসলের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি সেই সমস্যার সমাধান নয়। মাত্র ক’দিন আগে দিল্লি এসে এই যে কথাটা রাজন বলেন, তাতে তেলেবেগুনে ছ্যাঁক করে উঠে কমলনাথ বলেছিলেন, আমরাও মাঠেঘাটে ঘুরি। আমরাও কিছু কিছু জানি। সমস্যা কী, সমাধানও বা কী– তা আমাদের জানা আছে। অত জ্ঞান দেওয়ার কিছু নেই।
রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদদের এই কাজিয়া অবশ্যই নতুন নয়। এবং সেই কাজিয়ায় রাজনীতিকরা বরাবর জিতে আসছেন। সেই কবে থেকে কৃষিঋণ মকুবের রাজনীতি চলছে তো চলছেই! অথচ চাষিরা সেই তিমিরেই!
দেশের কৃষক সমস্যার চালচিত্র যখন এমন, তখন রঘুরাম রাজনের মন্তব্য বাড়তি আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তিনি নন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর্ত্য লাহিড়ী, সাজ্জিদ চিনয়, প্রাঞ্জুল ভান্ডারি, মৈত্রীশ ঘটক, নীলকান্ত মিশ্র, গীতা গোপীনাথ, প্রাচী মিশ্র, রোহিণী পান্ডে, ঈশ্বর প্রসাদ, ই. সোমানাথন ও কার্তিক মুরলীধরন– দেশের এই ১২ জন অর্থনীতিবিদ ‘অ্যান ইকনমিক স্ট্র্যাটেজি ফর ইন্ডিয়া’ নামে সম্প্রতি যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন, তার মূল সুরও রাজনের আবহসংগীতের ঘরানার। বরং, রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর যে গোপন তথ্যটি ফাঁস করেছেন, ভারতের নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনও দিন তা মেনে নেওয়া সম্ভব হবে কি না সন্দেহ! রাজনের দাওয়াই যতটা চমকপ্রদ, ততটাই ভীতিপ্রদ। তাঁর কথায়, ‘ভারতের নির্বাচন কমিশনকে আমি চিঠি লিখে বলেছি, কৃষিঋণ মকুব করার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যেন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, সামান্য কিছু কৃষক ঋণের এই সুবিধে পায়। যাদের চেনাজানা আছে, প্রধানত ঋণ পায় তারাই। গরিব কৃষক নয়। তাছাড়া, এই ঋণ মকুব রাজ্যগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দঁাড়ায়। কোষাগার ঘাটতির সামাল দিতে রাজ্যগুলো ডুবে যায় আরও ঋণের ফাঁদে।’
তাহলে প্রতিকারের উপায়? রাজনের সঙ্গে দেশের সেরা এই একডজন অর্থনীতিবিদ সেই উপায় বাতলেছেন। কৃষিক্ষেত্র ও জমিনীতিতে কাঠামোগত সংস্কার চাই। আর প্রয়োজন এই ক্ষেত্রে লগ্নি। রাজন বলেছেন, ‘কৃষিক্ষেত্রকে চনমনে শিল্প হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। ভোটের বছরে ঋণ মকুব হল সবচেয়ে সহজ ও চটজলদি উপায়।’ কৃষি-অর্থনীতিবিদ অশোক গুলাটি যাকে ‘গভীর ক্ষতের উপর ব্যান্ড এড লাগানো’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সেরা উপায় তাহলে কী? চাষের ‘ইনপুট কস্ট’ অর্থাৎ বীজ, সার, বিদ্যুৎ, জল, শ্রমের সঙ্গে উৎপাদিত ফসলের দামের পার্থক্য ঘোচানো একটা কাজ। ব্যাপক লগ্নির মাধ্যমে ফসল মজুত ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ‘কোল্ড চেন’ তৈরি, যাতে নষ্ট না হয়ে ফসল বাজারজাত করা যায়। প্রযুক্তির প্রয়োগ, যাতে বাজার ও চাহিদা সম্পর্কে কৃষককে সবকিছু জানানো যায়। বাজারের হদিশ দেওয়ার পাশাপাশি চাষিকে উৎপাদিত ফসল অন্যত্র রফতানির সুযোগ করে দেওয়া। এর ফলে নাসিকের পিঁয়াজ অ-বিক্রীত না থেকে অন্যত্র পাঠানো যাবে, পশ্চিমবঙ্গের আলু রফতানি করা যাবে অন্য রাজ্যে। কৃষককে বাজার সম্পর্কে ‘শিক্ষিত’ করে তোলা। বাজারের চাহিদা কেমন সে সম্পর্কে আগাম তথ্য জানা থাকলে কৃষক সেইভাবে তার পণ্য বাজারজাত করতে পারবে। মোটকথা, কৃষিকে কৃষিক্ষেত্রে আবদ্ধ না রেখে তাকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করা প্রয়োজন।
এই জরুরি কাজগুলো সারতে না পারলে কৃষির অমাবস্যা কোনও দিন কাটবে না। বছর বছর তা বাড়বে। বছর বছর কৃষিঋণও মকুব হবে। বেড়েই যাবে কোষাগার ঘাটতির বহর। ভোটে কেউ জিতবে, কেউ হারবে। দেনায় ডুববে রাজ্য। ডুববে কৃষককুলও।
কৃষির জন্য জরুরি এই নিদান কার্যকর হবে কি হবে না, সে জল্পনা এখন থাক। আপাতত সদ্য বলা রাহুল গান্ধীর কথাগুলো কানে বাজছে। ‘মোদিজি গরিব কৃষকদের ঋণের একটা টাকাও মকুব করেননি। অথচ শিল্পবন্ধুদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। দেশের কৃষকদের ঋণ মকুব না করলে মোদিজিকে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমতে দেব না। তিষ্ঠোতে দেব না।’ মঙ্গলবার পার্লামেন্টে ঢুকতে ঢুকতে সহাস্য রাহুল সাংবাদিকদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘দেখলেন তো? আমরা আমাদের কাজ শুরু করে দিয়েছি।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.