Advertisement
Advertisement

Breaking News

বাজপাখি যাবে ড্রাগন প্রাসাদে

উরাশিমা তারো সেই প্রাসাদ থেকে জাদুবাক্স নিয়ে আসে। দেখা যাক, হায়াবুসা কী আনে?

Japan's probe Hayabusa to land on asteroid
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 3, 2018 10:20 am
  • Updated:November 3, 2018 10:20 am

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়: কোনও গ্রহ বা উপগ্রহে নয়, মহাকাশযান এবার নামছে গ্রহাণুতে। সব ঠিকঠাক চললে মাস দুয়েকের মধ্যেই জাপানি স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান ‘হায়াবুসা ২’ নামবে পৃথিবীর কাছের গ্রহাণু রুগু-তে। ২০২০ নাগাদ এই গ্রহাণুর মাটি, পাথরের নমুনাও চলে আসবে পৃথিবীতে।

হঠাৎ সব ছেড়ে গ্রহাণু কেন?

Advertisement

জাপানি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘জাপান এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি’ অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার কীভাবে হল, তা খুঁজে বের করতে। দেখা যাচ্ছে, রুগুর মতো গ্রহাণু হল বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় কার্বন জাতীয় (একে ‘সি টাইপ’ গ্রহাণু বলা হয়), যেখানে প্রচুর পরিমাণে পাথর আর খনিজ পাওয়া যায়। মনে করা হয়, সৌরমণ্ডলের সৃষ্টির সময়কার এগুলো। ফলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এসব পাথর আর খনিজের মধ্যে মিললেও মিলতে পারে জল আর জৈববস্তুর ‘আদি’ রহস্য। এছাড়া মঙ্গল বা চাঁদ থেকে সরাসরি নুড়িপাথর তুলে এনে গবেষণা চালাতে পারলেও গ্রহাণু থেকে তা করা যায়নি। বিভিন্নভাবে গ্রহাণুর নুড়িপাথর সংগ্রহ করা গেলেও ঠিক কোন গ্রহাণুর অংশ– সেটা জানার কোনও উপায়ও ছিল না। আর কাজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, চাঁদ বা মঙ্গলে নামার চেয়ে কোনও অংশে সহজ নয় এসব গ্রহাণুতে নামা, বরং এবড়োখেবড়ো অসমতল জমি আর কম মাধ্যাকর্ষণের জন্য কাজটা অনেক বেশি দুরূহ। ছোট রুক্ষ জমিতে অবতরণের অভিজ্ঞতাও তো দরকার। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া মহাকাশ অভিযানে যা রীতিমতো দরকার। সব মিলিয়েই তাই এই গ্রহাণু অভিযান। আদতে জাক্সা-র এই গ্রহাণু অভিযানের শুরু ২০০৫-এর নভেম্বর মাসে যখন ‘হায়াবুসা ১’ অবতরণ করে পৃথিবীর কাছের গ্রহাণু বা ‘নিয়ার আর্থ অ্যাস্ট্রয়েড’ ইতোকাওয়া-তে। নমুনা সংগ্রহ করে বছর পাঁচেক বাদে ২০১০ সালের ১৩ জুন ফেরতও আসে। আর এই অভিযানের অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে ‘হায়াবুসা ২’ অভিযানে কাজে লেগেছে।

Advertisement

[ফন্দিপিসির দিল্লিবাক্সে বন্দি আশ্চর্য নেতার খবর]

যেমন মহাকাশযান থেকে গ্রহাণুকে সরেজমিনে দেখার জন্য গ্রহাণুতে রোভার নামানোর মতো বিষয়টা। মূল মহাকাশযানে থাকে ছোট ছোট গাড়ির মতো মহাকাশযান, যাদের পরিভাষায় ‘রোভার’ বলা হয়। এদের সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদানের জন্য ট্রান্সপন্ডার আর ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা থাকে। মূল মহাকাশযান অবতরণের আগে এরা জমিতে নেমে সরেজমিনে সব পরীক্ষা করে। এদের পাঠানো তথ্য আর ছবির উপরই প্রাথমিক ধারণা গড়ে ওঠে। তারপরই মূল মহাকাশযান অবতরণ করে। ‘হায়াবুসা ১’-এও ছিল মিনার্ভা নামের রোভার। তাকে গ্রহাণু ইতোকাওয়াতে নামানোর তোড়জোড়ও করা হয়। কিন্তু যোগাযোগ বিভ্রাটে ভুল উচ্চতায় রোভারকে ছাড়ে হায়াবুসা। ইতোকাওয়া-র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কম হওয়ায় রোভারটি গ্রহাণুতে না নেমে মহাকাশে হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে এই ভুল যাতে আর না হয়, তার দিকে নজর দিয়েছে ‘হায়াবুসা ২’।

জেনে নেওয়া যাক ১৯৯৯ সালে আবিষ্কৃত রুগু গ্রহাণুর হালহকিকত। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই ধরনের এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গ্রহাণুকে বলা হয় পৃথিবীর কাছের গ্রহাণু বা ‘নিয়ার আর্থ অ্যাস্ট্রয়েড’, কারণ এর কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের মধ্যে পড়ে। মোটামুটিভাবে এখনও পর্যন্ত এইরকম হাজার সতেরো গ্রহাণুকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। যেহেতু পৃথিবীর কক্ষপথে চলে আসে এসব গ্রহাণু, তাই স্বাভাবিকভাবেই এদের গতিবিধির উপর নজরও রাখা হয়। কে জানে কখন কে পৃথিবীর ঘাড়ে এসে পড়ে!
১৯৯৮-র ব্রুস উইলস আর বেন অ্যাফলেক অভিনীত হলিউড ব্লকবাস্টার ‘আর্মাগেডন’-মনে পড়ে যেখানে বিশাল গ্রহাণু ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে! কিংবা অ্যাসটেরিক্সের গ্রহাণুতে অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি। শোনা যাচ্ছে, ২০৩২ নাগাদ এক অতিকায় উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে পারে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা এই বিপদ থেকে বাঁচতে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে ভারতও এতে শামিল।

দক্ষিণ জাপানের ওসুমি দ্বীপের তানেগাশিমা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ‘এইচ টু এ’ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘হায়াবুসা ২’ উৎক্ষেপণ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ জুন এসে পৌঁছায় রুগুর কাছে। শুরু হয় গবেষণার কাজ। ‘হায়াবুসা ২’-এর রয়েছে গোটা চারেক রোভার। ঠিক হয়েছে এরাই গ্রহাণুর চার জায়গায় নেমে নমুনা সংগ্রহ করবে, ছবি তুলবে। ইতিমধ্যেই মিনার্ভা ‘১ এ’ আর ‘১ বি’ নামে দুটো রোভার রুগুর এবড়োখেবড়ো পৃষ্ঠে নেমেও পড়েছে। মিনার্ভা ছাড়াও রুগুর উপরিভাগ কেমন, দেখার জন্য নেমেছিল আরেকটা রোভার। ১৭ ঘণ্টা একনাগাড়ে কাজ করে সে অবশ্য দেহ রেখেছে। (অবশ্য এই মোবাইল অ্যাস্ট্রয়েড সার্ফেস স্কাউটের জীবনই ছিল মেরে-কেটে ১৬ ঘণ্টা মেয়াদের। সেই হিসাবে ঘণ্টাখানেক বেশিই বেঁচেছে স্কাউট।)

মাধ্যাকর্ষণ খুবই কম বলে এই দুই মিনার্ভা রোভারের যেমন চাকা নেই, তেমনই সরাসরি হায়াবুসা থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। এতে অবশ্য কোনও ক্ষতি হয়নি রোভার দুটোর। মোটামুটি লাফিয়ে লাফিয়ে গ্রহাণুর উপরিভাগের ছবি তুলে যাচ্ছে এরা। আর যেটা করছে, তা হল রুগুতে ঠিক যে জায়গায় হায়াবুসা ২ অবতরণ করবে সেটা ঠিকঠাক করে দেখা। হায়াবুসা ২ এখন রুগুর মাত্র ৩৯ ফুট উপরে রয়েছে। কিন্তু তা’ বলে এতটা মুশকিলে যে পড়তে হবে, তা অবশ্য বিজ্ঞানীরা ভাবেননি। এর কারণও ছিল। ২০০৫ সালে প্রথম হায়াবুসার ইতোকাওয়া গ্রহাণুতে অবতরণ করতে তেমন কোনও ঝামেলাই হয়নি। সমতল জায়গা পেয়ে ঝটপট নেমে গিয়েছিল প্রথম হায়াবুসা। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই দ্বিতীয় হায়াবুসা অভিযানকেও দেখেছিলেন বিজ্ঞানীরা। একজন তো বলেই ফেলেছেন– ‘এ তো দেখছি গ্রহাণু থেকে নমুনা আনার চেয়ে অবতরণ করা কোনও অংশে কম নয়।’

আদতে এই পাথরভরা পৃষ্ঠে নামা যে কত কঠিন, তা বিজ্ঞানীদের হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছে ২ অক্টোবরে স্কাউটের অবতরণ। অসমান পাথরে সামলাতে না পেরে স্কাউট তো প্রথমে উলটেই যায়। রোভারের যে ক্যামেরা থাকার কথা রুগুর দিকে, তা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষমেশ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্কাউটকে সোজা করা হয়। ভাগ্যিস পাথুরে জমি তত শক্ত নয়, না হলে বেকায়দায় পড়ে রোভারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি পর্যন্ত হতে পারত! কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। মাত্র ১৬ ঘণ্টা যার আয়ু, তার কাছে প্রতিটি মিনিটই যে মূল্যবান বলার অপেক্ষা রাখে? তাই রুগুতে ‘হায়াবুসা ২’-এর অবতরণ এখন বিজ্ঞানীদের প্রধান মাথাব্যথা। তিনটে রোভার মিলে যেসব ছবি পাঠিয়েছে তা থেকে বিজ্ঞানীরা রুগুর পৃষ্ঠের একটা ত্রিমাত্রিক মানচিত্র বানিয়েছেন। উদ্দেশ্য: মানচিত্র দেখে অবতরণের জন্য একটা জায়গা খুঁজে বের করা। কিন্তু তাতেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হচ্ছে না। রুগুতে ‘হায়াবুসা ২’-এর অবতরণের জন্য প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন ১৮০ মিটার চওড়া জায়গার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু জমি এতটাই অসমতল, পাথুরে যে সেটাকে কমিয়ে ৬৬ মিটার করা হয়েছে। এবার এই জায়গায় বিনা ঝঞ্ঝাটে নামতে হবে। এতে সমস্যার সমাধান আদৌ হবে কি না, তা বোঝার আগেই অন্য আরেক সমস্যা এসে হাজির। রুগুর কক্ষপথ এমনই যে এবার গ্রহাণুটা সূর্যের অন্য পিঠে চলে যাবে। মাসদুয়েক হায়াবুসার সঙ্গে যোগাযোগও থাকবে না রুগুর।

এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘খারাপ কী? আমরা তো মাসদুয়েক ভাবার সময় পেয়ে গেলাম অবতরণ নিয়ে!’

আদতে ২০১৩ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’-ও গ্রহাণু অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। নাম দেওয়া হয় ‘অ্যাস্ট্রয়েড ইনিশিয়েটিভ’। বলা হয়, তহবিল পেলে ২০২১-এর ডিসেম্বরে পৃথিবীর কাছের কোনও গ্রহাণু থেকে ৪ মিটার লম্বা পাথর নমুনা নিয়ে আসবে। মঙ্গল ও অন্য গ্রহে মহাকাশচারী পাঠানোর প্রথম ধাপ হিসাবেও এটা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু আপাতত ট্রাম্প-জমানা নাসার সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছে। অবস্থা বুঝে নাসাও পুরো প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তাই এখন এ ব্যাপারে হায়াবুসাই শিবরাত্রির সলতে। এক হিসাবে অন্য আঙ্গিকে গ্রহাণুকে দেখাও শুরু হয়েছে। এতদিন ধরে মনে করা হয়েছে, গ্রহাণু উল্কারা ধেয়ে আসছে ধ্বংস করতে। মানুষ এখন নিজেই পৌঁছে যাচ্ছে তার কাছে।

জাপানি ভাষায় ‘হায়াবুসা’ মানে বাজপাখি আর ‘রুগু’ হল জলের তলায় ড্রাগন রাজপ্রাসাদ। জাপানি উপকথায় জেলে উরাশিমা তারো সেই প্রাসাদ থেকে জাদুবাক্স নিয়ে আসে। দেখা যাক, হায়াবুসা কী আনে?

[পার্সেল খুলতেই আগুনের ফুলকি! বোমাতঙ্ক উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়ায়]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ