বিল সইয়ের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির জন্য বেঁধে দেওয়া হল সময়সীমা। এমনকী, উক্ত দু’জনের সই ছাড়া আইনে পরিণত হল দশটি বিল। সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে বোঝা গেল, জনতার ঊর্ধ্বে কেউই নন। আগামী দিনে এই রায় বহাল থাকলে পোক্ত হবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো।
সম্পর্ক অহি-নকুলের, কিন্তু পাকিস্তানও ভারতকে অনুপ্রাণিত করে। কিংবা ট্রাম্পের দেশ। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও আর মাধবন সম্প্রতি যে রায় দিয়ে ইতিহাসে ঢুকে পড়েছেন, তার প্রেরণা তাঁরা এই দুই দেশের সংবিধান থেকেই পেয়েছেন।বিল সইয়ের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির জন্য সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার রায় শুধু ঐতিহাসিকই নয়, যুগান্তকারীও। এই রায়ের ফলে রাষ্ট্রপতিও আর বিচারের ঊর্ধ্বে রইলেন না। তিনিও জবাবদিহিতে বাধ্য থাকবেন। তঁার ‘নিষ্ক্রিয়তা’ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। শুধু তাই নয়, স্বাধীন ভারতে এ-যাবৎ যা হয়নি, এই প্রথম তা-ও হয়ে গেল। রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির সই ছাড়াই আইনে পরিণত হল দশ-দশটি বিল। অভূতপূর্ব এই রায় স্তম্ভিত করেছে সবাইকে। বিহ্বলতা কাটিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারও ভাবছে, কত দ্রুত রিভিউ পিটিশন দাখিল করা যায়।
রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্বের ইতিহাস বহু প্রাচীন। এ-দেশে রাজ্যপালের নিয়োগ সর্বদাই হয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছানুযায়ী। কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক মধুর না হলে রাজ্যপালকে ঢাল করে কেন্দ্র তার ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়ে এসেছে রাজ্যের উপর। সেই লড়াইয়ে প্রায় সবসময়ই জয় হয়েছে কেন্দ্রের। কখনও ভেঙে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকার, কখনও সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনিক অচলাবস্থা। বোম্মাই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এখন আর হুট বলতে সরকার ভাঙা হয় না। কিন্তু তাই বলে বিরোধী রাজ্যগুলির উপর রাজ্যপালকে দিয়ে কেন্দ্রের খবরদারি বন্ধ হয়নি। তামিলনাড়ু, কেরল বা পশ্চিমবঙ্গে এখনও যা ঘটে চলেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর আদর্শ বিজ্ঞাপন বলে অবশ্যই বিবেচিত হবে না।
রাজ্যপালের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে তামিলনাড়ু সরকারই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। হওয়ার কারণও ছিল। কেরলের লোক হলেও তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল এন. রবি ছিলেন বিহার ক্যাডারের আইপিএস। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরোয় থাকাকালীন তিনি নজরে পড়েন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। মোদি ও তঁার ‘ম্যান ফ্রাইডে’ অমিত শাহ নাগাল্যান্ডের রাজ্যপাল পদ থেকে সরিয়ে রবিকে বসিয়েছিলেন তামিলনাড়ুতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে। তিন মাস কাটতে না-কাটতেই খিটমিট লেগে গেল মুখ্যমন্ত্রী এম. কে. স্ট্যালিনের সঙ্গে। সম্পর্কের সেই নিম্নগামিতা দিন দিন তীব্রতর হয়েছে। এতটাই যে, সাড়ে তিন বছর ধরে রাজ্য বিধানসভায় পাস হওয়া দশটি বিল সই না করে রবি আটকে রেখেছিলেন। সেই বিলগুলোর মধ্যে ন’টি রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপালের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার বিধান দেওয়া আছে। কোথাও বলা হয়েছে, আচার্য থাকবেন রাজ্যপালই। তবে আলংকারিক। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে রাজ্য সরকারের হাতে। রাজ্যপাল রবি ওই দশটি বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠিয়ে চুপটি করে বসেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট সেই অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর পাশাপাশি যে-রায় দিয়েছে, পুনর্বিবেচনার পর আগামী দিনে তা বহাল থাকলে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আরও পোক্ত হবে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কও হবে আরও স্বাভাবিক।
সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতি দু’জনের ক্ষেত্রেই বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কেউ-ই অনির্দিষ্টকাল বসে থাকতে পারবেন না। রাজ্যপালের ক্ষমতা আছে আপত্তি নির্দিষ্ট করে যে কোনও বিল বিধানসভায় ফেরত পাঠানোর। কিন্তু সেই বিল দ্বিতীয়বার ফেরত এলে তিনি সই করতে বাধ্য থাকবেন। তিন মাসের মধ্যে তঁাকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজন বোধ করলে রাজ্যপাল বিবেচনার জন্য কোনও বিল রাষ্ট্রপতির কাছেও পাঠাতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকেও তিন মাসের মধ্যে সম্মতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনন্তকাল কেউই নিষ্ক্রিয় থাকতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির আপত্তি থাকলে বা সিদ্ধান্ত নিতে সময় বেশি লাগলে সেই বিলম্বের কারণ রাজ্য সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট এ-কথাও বলেছে, রাষ্ট্রপতির কাছে বিবেচনার জন্য কোনও বিল রাজ্যপাল পাঠাতেই পারেন। কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানো বিল দ্বিতীয়বার রাজ্যপালের কাছে ফেরত এলে সেই বিল তিনি রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠাতে পারেন না। পরামর্শ করতে হবে আগে।
যুগান্তকারী এই রায়ের মূল নির্যাস এটাই যে, জনগণই সুপ্রিম। জনতার ঊর্ধ্বে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতিও নন। দু’জনের কেউ-ই ‘অ্যাবসলিউট ভিটো’ বা ‘পকেট ভিটো’ প্রয়োগ করতে পারেন না। সেই অধিকার আছে একমাত্র জনগণের। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছে, অনন্তকাল বিল সই না করে ফেলে রাখা সাংবিধানিক অচলাবস্থারই নামান্তর। তাই বিল সই করা নিয়ে ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতির জন্য কোনও সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া না হলেও সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সিদ্ধান্ত না নিয়ে অনন্তকাল বসে থাকা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সাংবিধানিক পদাধিকারী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (তিন মাস) সিদ্ধান্ত না নিলে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা আছে।
এই রায় শেষ পর্যন্ত বহাল থাকলে ভবিষ্যতে কোনও রাজ্য বিল সই না-করার দায়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতেই পারে। সেক্ষেত্রে কী হতে পারে, তা আপাতত কল্পনা। ভারতীয় গণতন্ত্র কতটা মজবুত, সেটা হবে তার বড় পরীক্ষা। সেই কাল্পনিক অবস্থায় ঘোরাফেরা না-করে বরং কেন্দ্রের শাসক ও তার অনুগত রাজ্যপালের ভূমিকা আবার একটু খতিয়ে দেখা যাক। কংগ্রেস আমলে রাজ্যপালদের হাতিয়ার করে যথেচ্ছাচারের ভূরি ভূরি নিদর্শন রয়েছে। দশ বছর যাবৎ বিজেপিও হঁাটছে সেই পথে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বিজেপি বরং বাড়তি এমন কিছু করেছে, যা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। যেমন, কেন্দ্রশাসিত দিল্লিতে নির্বাচিত সরকারের চেয়ে ক্ষমতাধর করে তুলেছে উপ-রাজ্যপালকে।
নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে পদে পদে হেনস্তা করেছেন অনির্বাচিত উপ-রাজ্যপাল। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে জম্মু-কাশ্মীরেও। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সঙ্গে নিত্য ঠোকাঠুকি চলছে উপ-রাজ্যপাল মনোজ সিন্হার। এই ধরনের যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে অগোছালো বিরোধীকুল অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে আদালতের দিকে। নিম্ন আদালতের নানাবিধ আচরণ, এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ভূমিকাও, বিস্ময় সৃষ্টি করছে। বিজেপির সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে কোনও প্রতিষ্ঠান এখনও যদি নিজেদের কিছুটা বঁাচিয়ে রাখতে সমর্থ হয়ে থাকে, তাহলে তা সুপ্রিম কোর্ট। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে, সিএজি, সিভিসি, ইডি, সিবিআই, এসএফআই, প্রত্যেকেই আজ ‘সরকারি তোতা’। এই ‘টোটাল কন্ট্রোল’-এর মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মাথা তুলে দৃঢ়তা ও স্বাধীনচেতার কিছুটা জানান একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট-ই দিচ্ছে। বিজেপি তাই সেখানেও থাবা বসাতে মরিয়া। বিচারপতি নিয়োগে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার হতে তাই তারা এত ব্যগ্র।
রাজ্যপালের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতিকেও সুপ্রিম কোর্টের আওতায় এনে গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মজবুত করার যে-বার্তা সর্বোচ্চ আদালত দিল, তার ভবিষ্যৎ দেখার আগ্রহ তাই জিইয়ে থাকছে। রিভিউ পিটিশনের সিদ্ধান্ত পাকা হলে চূড়ান্ত রায়ের উপর নির্ভর করবে ভারতীয় গণতন্ত্রর পরবর্তী প্রবাহ। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে বিচারপতি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মাধবনের অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা শুরুতে বলেছি।
তামিলনাড়ু মামলার রায়ে তঁারা দু’জনেই ওই দুই দেশের সংবিধানের উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা আছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (পাকিস্তানে দশ দিন) প্রেসিডেন্ট সই না-করলে ধরে নিতে হবে বিলে সম্মতি পাওয়া গিয়েছে। দুই বিচারপতি সেইভাবে তামিলনাড়ুর দশটি বিল রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির সই ছাড়াই আইনে পরিণত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এবং সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট এই একই কাজ করেছিল দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও। ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্পিকারের সময়সীমাও তিন মাস বেঁধে দিয়েছিল। পরবর্তী আকর্ষণ, নিশ্চিতভাবেই, ক্ষুরধার আইনি ব্যাখ্যা। জনগণ না রাষ্ট্রপতি– সবার উপরে কে, সেই কাউন্টডাউন শুরু হল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.