উপনিষদে আছে, ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্ দ্বিতীয়া নাস্তি’, আর ইসলামে রয়েছে, মূলমন্ত্র ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। অর্থাৎ, ঔপনিষেদিক ভাষ্যে ‘ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়’ আর ইসলামি চিন্তায়– ‘আল্লাহ-ই একমাত্র উপাস্য’– দুই মতাদর্শে ফারাক নেই। যাঁরা বিবেকানন্দকে হিন্দুত্বের ‘আইকন’ হিসাবে তুলে ধরতে প্রবল উৎসাহী, তারা এই দিকগুলিকে অবহেলা করে। স্বামীজির জন্মদিনে বিশেষ নিবন্ধ। লিখছেন দেবাশিস পাঠক।
১৮৯৮ সালের গ্রীষ্মকালে বিবেকানন্দ অমরনাথ দর্শনে গিয়েছিলেন। যাত্রা-সঙ্গীদের মধ্যে নিবেদিতাও ছিলেন। নিবেদিতার ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম’ বইতে এই যাত্রার বিবরণ রয়েছে। সেখানে নিবেদিতা লিখছেন, যাত্রাপথে হিন্দু সন্ন্যাসীরা গেরুয়া রঙের তাঁবু খাটিয়ে থাকতেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা ‘পণ্ডিত’ (নিবেদিতার ভাষায়, ‘The more learned of them’), তাঁরা বিবেকানন্দর কাছে আসতেন নানা বিষয়ে আলোচনার জন্য। এই গৈরিকধারী সাধুরা, বিবেকানন্দর কথায়, স্বদেশ-বিদেশ পৃথকীকরণের তাৎপর্য বুঝতেন না। তাঁরা বলতেন, “স্বদেশ বিদেশের পার্থক্য কী আছে সবাই’ত মানুষ।”
আবার, এই সমদর্শী সাধুরাই বিবেকানন্দর ইসলাম প্রীতির কারণ বুঝতেন না। হিন্দু-মুসলমানকে ‘এক’ করে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন না। পাঞ্জাবের মাটিতে, ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমান আক্রমণে বহু হিন্দুর রক্ত ঝরেছিল, প্রাণ গিয়েছিল। তাই এই বীতরাগ, এই গোঁড়ামি। স্বামীজি সেটা বুঝতেন। আর তাই সে-বিষয়ে বিশেষ জেদাজেদি করতেন না।
নিবেদিতা অবাক হয়ে লক্ষ করেছেন, ‘এদিকে সেখানকার তহশিলদার এবং অনেক কর্মচারী ও ভৃত্যবৃন্দ মুসলমান ছিল’– সেই বিষয়টা স্ববিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তা নিয়ে কেউ আপত্তি করেনি। এমনকী, যখন সেখানকার মুসলমান ‘তহশিলদার এবং আরও কেউ কেউ স্বামীজীর শিষ্য হবার জন্য তঁার নিকট প্রার্থী হয়েছিল’– তখনও সেটা কারও ‘খুব অস্বাভাবিক বা অসঙ্গতিপূর্ণ’ বলে মনে হয়নি।
প্রায় ১২৭ বছর আগেকার ঘটনা। তবু স্বামীজির ১৬৩তম জন্মদিনে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, এখনকার ভারতেও প্রায় একই ছবি দেখা যাচ্ছে। আর, সেই সূত্রে যঁারা বিবেকানন্দকে হিন্দুত্বের ‘আইকন’ হিসাবে তুলে ধরতে প্রবল উৎসাহী, তঁারা সোৎসাহে বিবেকানন্দর ইসলাম প্রীতিকে, মুসলমান ধর্ম ও শাসন নিয়ে বক্তব্যকে আড়াল করতে প্রবলতরভাবে আগ্রহী। উপনিষদে আছে– ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্ দ্বিতীয়া নাস্তি’ , আর ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। অর্থাৎ, ঔপনিষেদিক ভাষ্যে ‘ঈশ্বর এক
এবং অদ্বিতীয়’ আর ইসলামি চিন্তায় ‘আল্লাহ-ই একমাত্র উপাস্য’– এই দুই মতাদর্শে ফারাক নেই।
দুই ধর্মের চিন্তা-দর্শনে এরকম সাদৃশ্যের কথা বিশ্বনাথ দত্তর বড় ছেলের অজানা ছিল না, কারণ বাবা নরেন্দ্রনাথকে ‘বাইবেল’ আর ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তঁাদের বাড়িতেও কোরান পঠিত হত। ‘উদ্বোধন’ কর্তৃক প্রকাশিত স্বামী বিবেকানন্দর ‘বাণী ও রচনা’-র অষ্টম খণ্ডর সাত-আট পৃষ্ঠায় এবং অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্করীপ্রসাদ বসু ও শঙ্কর সম্পাদিত ‘বিশ্ব বিবেক’ (‘বাক সাহিত্য’ কর্তৃক প্রকাশিত) বইয়ের ১৪৮ নম্বর পৃষ্ঠায় এ-কথা স্পষ্টরূপে উল্লিখিত। ছোটবেলা থেকে এরকম পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা। তার উপর প্রবল ইতিহাস সচেতনতা। যুগপৎ এই দু’টি কারণ বিবেকানন্দকে ইসলাম অনুরাগী ও হিন্দুত্বর মৌলবাদী ধারণার উল্টোদিকে বসিয়েছিল। শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছেন, ‘ভারতবর্ষের এই যে সব সন্ন্যাসীর মঠ ফঠ দেখতে পাচ্ছিস– এসব বৌদ্ধদের অধিকারে ছিল, হিন্দুরা সেই সকলকে এখন তাদের রঙে রাঙিয়ে নিজস্ব করে বসেছে।’
বাবরি মসজিদ ভেঙে যাঁদের ধর্মবিজয় শেষ হয়নি– সম্ভল থেকে কাশী– সর্বত্র যাঁরা মাটির নিচে স্বধর্ম খুঁজছেন, তাঁদের জন্য এসব কথা বিশেষ স্বস্তিদায়ক নয়। একইভাবে তাঁদের অস্বস্তির উপচার হতে পারে স্বামীজির আরও কিছু বিশ্লেষণী ভাবনা। মারাত্মক ছিল তাঁর যুক্তি– ধর্মান্তরকরণের কারণ খুঁজতে বসে। তিনি লিখছেন, ‘ভারতবর্ষে দরিদ্রদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন? একথা বলা মূর্খতা যে, কেবল তরবারির জোরে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়। বস্তুত জমিদার ও পুরোহিতদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই তাঁরা ধর্মান্তর গ্রহণ করেছিলেন, সেইজন্য বাংলাদেশে, যেখানে কৃষকদের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান বেশী।’ (সূত্র: ‘বাণী ও রচনা’, খণ্ড ৫, পৃ. ১৯১)।
মুসলমান-বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদীরা হামেশাই একটি কথা বলে থাকে। বলে যে, মুসলমান আক্রমণের সময় দেশে হত্যালীলা ও নিধনযজ্ঞের সূত্রপাত। অথচ বিবেকানন্দ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “যদি কোনও শুদ্র বেদমন্ত্র শ্রবণ করত তাহলে তার কর্ণকহরে জ্বলন্ত সিসা ঢেলে দেওয়া হতো, যদি সে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করত তার জিহ্বা ছেদন করা হতো। যদি সে ব্রাহ্মণকে ‘ওহে ব্রাহ্মণ’ বলে সম্বোধন করত, তাহলেও তার জিহ্বা ছেদন করা। ঋক ও অথর্ব বেদে দাস ও দস্যু জাতিকে অগ্নিসংযোগে হত্যা করবার নির্দেশ দেওয়া আছে।” আবার তথ্য-যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাসচেতনা তঁাকে দিয়েই বলিয়েছে, ‘ভারতে মুসলমানেরাই প্রথম পরধর্মাবলম্বীর বিরুদ্ধে তরবারি ধারণ করিয়াছিলেন।’ (‘বাণী ও রচনা’, খণ্ড ৯, পৃ. ৪৩৯)।
একইভাবে বিবেকানন্দ জানতেন ও মানতেন, মুসলমানরা ‘তরবারির সাহায্যে প্রত্যেক পদ অগ্রসর হইয়াছিল– তাহাদের এক হস্তে ছিল কোরান, অপর হস্তে তরবারি; হয় কোরান গ্রহণ কর, নতুবা মৃত্যু আলিঙ্গন কর, আর অন্য উপায় নাই।’ কিন্তু ধর্ম যদি বলের বন্যায় ভেসে যায়, তবে ধর্মের কী হাল হয়, সেটাও তাঁর জানা ছিল বইকি। তাই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘ইতিহাস-পাঠক-মাত্রেই জানেন, তাহাদের অভূতপূর্ব সাফল্য হইয়াছিল। ছয়শত বৎসর ধরিয়া কেহই তাহাদের গতিরোধ করিতে পারে নাই; কিন্তু পরে এমন এক সময় আসিল, যখন তাহাদিগকে অভিযান থামাইতে হইল। অপর কোন ধর্ম যদি ঐরূপ পন্থা অনুসরণ করে, তবে তাহারও একই দশা হইবে।’ (‘বাণী ও রচনা’, খণ্ড ৩, পৃ.১৮৬-৮৭)।
বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণে যঁারা হিন্দু ধর্মের পরাকাষ্ঠা দেখেছেন, তাঁদের জন্যই বোধহয় তিনি বলে গিয়েছিলেন, হিন্দু ধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও ধর্মের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। এবং বিবেকানন্দর সমন্বয়ী ভাবনার কথা উঠলেই একটা কথা প্রায় প্রত্যেকে বলে থাকে। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘আমি মানস চক্ষে দেখিতেছি এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।’
‘বৈদান্তিক মস্তিষ্ক’-র অর্থ হল, বেদান্ত দর্শনের তত্ত্ব অনুযায়ী, সমগ্র মানব জাতিকে আত্মা বলে দেখা এবং সবার সঙ্গে সেরূপ আচরণ করা। ‘ইসলামীয় দেহ’-র অর্থ কী? তবে কি মুসলিমদের মস্তিষ্কগুণ বর্জত ভেবেছিলেন বিবেকানন্দ? বোধহয় তেমনটা নয়। ১৫-১৬ শতকে ইউরোপে যে-নবজাগরণ ঘটে, তার প্রধান সূত্র যে মুসলিম মনীষা এই তথ্যের উল্লেখ তো করেছেন ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ প্রবন্ধে। ‘ইসলামীয় দেহ’-র অর্থ সম্ভবত এই যে, ইসলামীয়রা যেমন তাদের সমাজের দিক থেকে পরস্পরকে নিজ ভাইয়ের মতো একাত্ম করে দেখেন এবং সেরূপ ব্যবহার করেন, সেই ভাবের বিস্তার।
স্বামী বিবেকানন্দ মানতেন, ‘বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানবজাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই– যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরাণও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরাণের সমন্বয়ের দ্বারাই ইহা করিতে হইবে।’ (‘পত্রাবলী’, স্বামী বিবেকানন্দের ‘বাণী ও রচনা’, খণ্ড ৮, পৃ. ২৫-২৬।) বলা বাহুল্য, সেই চিন্তার অনুসারী হওয়াই ‘ভারতীয়’ চেতনা জাগিয়ে রাখার অনিবার্য প্রকরণ।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.