Advertisement
Advertisement

Breaking News

Maharashtra

বিজেপির মারাঠা বিজয়, হেয়ালির উত্তর খুঁজছে গেরুয়া শিবিরও

মহারাষ্ট্রে বিজেপির জোট জিতেছে তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে।

Victory of BJP in Maharashtra
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:November 27, 2024 5:10 pm
  • Updated:November 27, 2024 5:11 pm  

মহারাষ্ট্রে বিজেপির জোট জিতল তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে। ভারতের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কোনও ভোটে এমন দাপট দেখিয়ে জিততে পারেনি। পাঁচ মাসে কোন ভোজবাজি ঘটে গেল যাতে এত বড় একটি রাজ্যের এতগুলো আসন শারদপ্রাতে শিউলি ঝরার মতো বিজেপি-জোটের কোলে ঝরে পড়ল? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

রাজনীতি কখনও সরলরেখায় চলে না। তার পথ সদাই বক্র। সেই কারণে রাজনীতি হেঁয়ালিতে
ভরা। সব হেঁয়ালির জট সবসময় খোলেও না। অনেক কিছু রহস্যাবৃত থাকে। তা ঘিরে গড়ে ওঠে গভীর বিস্ময়।

Advertisement

সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় রাজনীতি তো বটেই, কূটনীতি ও বিদেশনীতিতেও একের পর এক বিস্ময় সৃষ্টি হচ্ছে। কেন, কী কারণে, কোন যুক্তিতে, অনেক ভেবেও তা বোঝা দায়। এই যেমন ‘চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি’-তে পাকিস্তানে ক্রিকেট দল পাঠাতে ভারতের কীসের এত অনীহা, এত আড়ষ্টতা, বোঝা দায়। পাকিস্তানের সঙ্গে এক টেবিলে বসে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কেন এত আপত্তি? তাদের চেয়ে ঢের বেশি শত্রুতা তো চিন করে চলেছে! বারবার নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে। গালওয়ান সংঘর্ষের পর লাদাখে নতুন করে তারা ভারতের জমি দখল করেছে। অথচ, ভারত তাদের সঙ্গে জলচল বন্ধ করেনি। শীর্ষ নেতারা দেশ-বিদেশে দিব্যি মুখোমুখি হচ্ছেন। হ্যান্ডশেক করছেন। আলোচনায় বসছেন। অথচ পাকিস্তান?

বাকু-তে জলবায়ু সম্মেলনে কেন প্রধানমন্ত্রী গেলেন না তা-ও বিস্ময়ের। তিনি নিজেই নিজেকে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর নেতৃপদে বসিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন গ্লোবাল সাউথের মুখপাত্র। বাকু গিয়ে জোরালোভাবে দক্ষিণ বিশ্বের দাবি জানিয়ে তিনি অনায়াসে ব্রাজিলে ‘জি২০’ সম্মেলনে যোগ দিতে পারতেন। অথচ, নিজে তো গেলেন-ই না, পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবকেও যেতে দিলেন না! বাকুতে ভারতীয়দের লজ্জা ঢাকার সত্যিই কোনও উপায় ছিল না। জলবায়ু অন্দোলনে উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া ভারত এবার বাকুতে একটা প্যাভিলিয়ন পর্যন্ত দেয়নি। কেন, সেই হেঁয়ালিও অস্পষ্ট।

রাজনীতির হেঁয়ালি ও রহস্য আবার পরতে পরতে। গত বছর মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়, এবং এবার হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রর ভোটের ফল বিপুল বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। নানা প্রশ্ন উঠেছে। সন্দেহ জেগেছে। অথচ, সদুত্তর নেই। ভোটার-চরিত্র কী করে এভাবে এত দ্রুত বদলাতে পারে, সেই ব্যাখ্যাও কেউ দিতে পারছে না। মাত্র পাঁচ মাসে ভোটার-মন বদলের এমন নজির সাম্প্রতিকে দেখা যায়নি। পরাজিতদের বিস্ময়ের ঘোর না-কাটা স্বাভাবিক, কিন্তু সত্যি হল, জয়ীরাও বিমূঢ়। বিহ্বল। তাদের কাছেও এই হেঁয়ালি উত্তরহীন।

গত বছর নভেম্বরে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে ভোট হয়েছিল, এবার হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে। সব ধারণা, সমীক্ষা, ব্যাখ্যা মিথ্যে করে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি জিতেছিল ৭ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে। তাতে ভুরু কুঁচকেছিল। নানা প্রশ্ন উঠেছিল। কালের নিয়ম ও শাসকের দাপাদাপিতে তা ধামাচাপা পড়ে। এবার মহারাষ্ট্রে বিজেপির জোট জিতল ১৪ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি ঘটিয়ে ও তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে। ভারতের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কোনও ভোটে এমন দাপট দেখিয়ে জিততে পারেনি। বিস্ময় আরও এই কারণে যে, মাত্র পঁাচ মাস আগে ওই রাজ্যে লোকসভা ভোটে মোদির ভাবমূর্তি ও জোটের চালচিত্র দুটোই ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছিল। বিরোধীদের চেয়ে তারা এক শতাংশ ভোট ও ২৮টি আসন কম পেয়েছিল। পঁাচ মাসে কোন ভোজবাজি ঘটে গেল যাতে এত বড় একটি রাজ্যের এতগুলো আসন শারদপ্রাতে শিউলি ঝরার মতো বিজেপি-জোটের কোলে ঝরে পড়ল? স্বর্গবাসী হ্যারি হুডিনিও এই ভোজবাজিতে ভ্যাবাচাকা খাবেন।

সেদিক থেকে দেখলে মাসখানেক আগে হওয়া হরিয়ানার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের ভোটের বেশ মিল। হরিয়ানায় ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আরও পঁাচ বছরের ছাড়পত্র বিজেপি আদায় করে মাত্র মাস দেড়েক আগে। সেটাও এক মহারহস্য। কেননা, হরিয়ানার ফল নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল বা সাংবাদিক কুলে কাউকে একটিবারের জন্যও সন্দিহান হতে দেখা যায়নি। ভোটের আগে সব ওপিনিয়ন পোল ও ভোটের পর বুথফেরত সমীক্ষা কংগ্রেসের জয় ঘোষণা করেছিল। দ্বিমত ছিল না। একডজন সমীক্ষা খতিয়ে দেখছি, কংগ্রেসকে ৫৫ আসনের নিচে কেউ নামায়নি, কেউ কেউ ৯০-এর মধ্যে ৭২টি আসনও তাদের দিয়েছিল। অথচ, বিজেপি একাই জিতল ৪৮ আসন! কীভাবে? তা কি কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব, জাট নেতা ভূপিন্দর সিংয়ের উপর অতিনির্ভরতা এবং দলিত নেত্রী শৈলজার গোসার জন্য, না কি নেপথ্যে অন্য কিছু? সেই রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। পুরনো কাগজে বিজেপির অন্দরমহলের হতাশার জ্বলজ্বলে খবরও দেখছি, যেখানে লেখা, দেওয়াল লিখন দেখেই নাকি মোদি হরিয়ানায় কম জনসভার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

একইরকম কম জনসভা মোদি করেছেন মহারাষ্ট্রেও। হরিয়ানায় করেছিলেন ৮টি, মহারাষ্ট্রে ১টি বেশি। কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে সেটাও নাকি ছিল নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখার কৌশল। কিন্তু হরিয়ানার মতো মহারাষ্ট্রও বিস্ময়ের অন্য এক ঝাঁপি খুলে দিল। এই প্রথম দেখা গেল, কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল লোকসভা ভোটে পর্যুদস্ত হয়েও মাত্র পাঁচ মাসে বিধানসভা ভোটে চমক সৃষ্টি করল। ভোট-রাজনীতির এই উল্টো প্রবাহ, বারাণসীর উত্তর প্রবাহিনী গঙ্গার মতো, কী করে সম্ভব? তা কি স্রেফ ‘লাডলি বহেনা’ প্রকল্পের জন্য? ওই প্রকল্প বিজেপির স্ট্রাইক রেট এমন বিস্ময়কর করে তোলার পক্ষে নিশ্চিতই যথেষ্ট নয়। যাদের কাজকে ভোট-পণ্ডিতরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন, সেই সিএসডিএস-লোকনীতির সমীক্ষা পর্যন্ত দেখিয়েছে, ‘লাডলি বহেনা’ যোজনার দরুন বিজেপি জোটের ভোট ৪ শতাংশ বেড়েছে। তাহলে বাকি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি হলটা কী করে? ১৪৮ আসনে লড়াই করে বিজেপি কবে কোন রাজ্যে ১৩২ আসনে জয়ী হয়েছে? বিশেষ করে সেই রাজ্যে যেখানে পঁাচ মাস আগে ৪৮ লোকসভা আসনের মধ্যে তাদের জুটেছিল মাত্র ১৭ আসন?

পোস্টমর্টেমে চারটি বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে। এক, লাডলি বহেন যোজনা। দুই, আরএসএসের গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠা। তিন, ধর্মীয় মেরুকরণের চিরায়ত রাজনীতি। চার, নরেন্দ্র মোদির দুর্নিবার আকর্ষণ। ভাল কথা।
লাডলি বহেনা যোজনায় মহারাষ্ট্রের ‘অর্ধেক আকাশ’ যদি এভাবে আচ্ছন্ন হয়, ঝাড়খণ্ডে বিজেপির ‘গোগো দিদি যোজনা’ কেন তাহলে হেমন্ত সোরেনের ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’-কে হারাতে পারল না? রাজ্যের নারীদের হেমন্ত দিচ্ছেন মাসে মাত্র ১০০০ টাকা, মোদির গ্যারান্টি ছিল ২১০০ টাকা! তাহলে? লোকসভা ভোটে আরএসএসের অভিমানী হওয়ার গল্প শোনা গিয়েছিল। এবার তারা নাকি গা ঝাড়া দিয়েছে। সে-ও ভাল কথা। তাহলে ঝাড়খণ্ডে আরএসএস কিছু করতে পারল না কেন? মোদি-ম্যাজিকই বা কেন মায়াজাল বিছোতে ব্যর্থ? ঝাড়খণ্ড দখল করতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি তো তিনি রাখেননি? বাকি রইল ধর্মীয় মেরুকরণের যুক্তি। মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে তিনটি নতুন স্লোগান এবার জনপ্রিয় হয়েছে। এক, ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’।

অর্থাৎ, হিন্দু জনতা বিভাজিত থাকলে মুসলমানদের ছোবল খেতে হবে। দুই, ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’। মানে, জোটবদ্ধ থাক, নিরাপদে থাক। তৃতীয়টি মোদির দেওয়া– ঝাড়খণ্ডের লড়াই ‘রোটি, বেটি ও মাটি’ রক্ষার। সারার্থ, বাংলাদেশি মুসলমানরা ঝাড়খণ্ডে ঢুকে প্রথমে আদিবাসীদের রুটিতে খাবলা মারছে। তারপর তারা আদিবাসী মেয়েদের বিয়ে করছে, এবং এভাবে মুসলমানরা আদিবাসীদের জমির দখলদার হচ্ছে। এই শিহরনকারী শঙ্কা মহারাষ্ট্রে হিন্দু-মনে প্লাবন ঘটাল, অথচ ঝাড়খণ্ডে পড়ল মুখ থুবড়ে? একই চিত্রনাট্য এক রাজ্যে হিট অন্য রাজ্যে ফ্লপ? কুশীলবরা তো অভিন্ন! তাহলে?

রহস্য অবশ্যই অন্যত্র। তা উদ্‌ঘাটনে প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনের ময়নাতদন্ত। মহারাষ্ট্রে বিজেপি না-জিতলে আদানির ধারাবি প্রকল্পের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটত। কেন্দ্রপিছু ৫০ কোটি টাকা হরির লুটের গল্পও পল্লবিত। নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট হলে ইভিএমের কেরামতি সন্দেহাতীত হতে পারে না। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো কিছু রহস্য অনুদ্ঘাটিতই থাকে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভোট-রাজনীতির
হেঁয়ালিও তেমনই।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement