বিশ্বদীপ দে: অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে অতিকায় রুপোলি পর্দায় যে জীবন ফুটে ওঠে তা আসলে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। জীবনকে ছাপিয়ে এক অতি-জীবন। কেরানি-গৃহবধূ-কলেজ পড়ুয়াদের চোখে ফুটে ওঠে বিস্ময়ের অপরূপ তুবড়ি। দেখতে দেখতে এই বিস্ময় পেরিয়ে এসেছে বহু দশক। পর্দার নটনটীদের জীবন ঘিরে কৌতূহলের রঙিন বুদবুদের ভেসে চলা আজও অব্যাহত। আর তা আমরা দেখতে পাই এদেশের চলচ্চিত্রচর্চার প্রায় শুরুর দিন থেকেই। যে ‘গল্প’ করতে বসলেই একটি নাম অবধারিত ভাবে ফুটে ওঠে। তিনি দেবিকা রানি। আজও নাজম-উল-হুসেনের সঙ্গে তাঁর পালিয়ে যাওয়ার গল্প কান পাতলে বুঝি শোনা যাবে টিনসেল টাউনের বাতাসে। স্বামী হিমাংশু রায় সেদিন স্ত্রী ও তাঁর প্রেমিকের সন্ধানে হাজির হয়েছিলেন কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে। তারপর কী হল? এই ঘটনা কীভাবে ‘হিরো’ করে তুলল অশোক কুমারকে, সে গল্প সত্যিই চমকপ্রদ। তবে সেকথায় যাওয়ার আগে দেবিকাকে একবার চিনে ওঠা দরকার।
দেবিকা রানির জীবনে বিতর্ক অবশ্য তার আগেই তৈরি হয়েছিল। স্বামী হিমাংশু রায়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ চুম্বন আজও মিথ হয়ে রয়েছে। ‘কর্ম’ (১৯৩৩) ছবির সেই চার মিনিটের চুম্বন আজও কার্যতই বেনজির হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেই চুম্বনদৃশ্য এত বেশি আলোচিত হওয়াতেই বোধহয় নাজমের সঙ্গে তাঁর প্রণয়কাহিনি অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত। আসলে দেবিকা ছিলেন এমন এক নারী, যিনি জীবনের প্রথম থেকেই দৃঢ়চেতা ও বেপরোয়া। নিজের মতো করে জীবনকে তিনি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এমন আশ্চর্য মানুষ চমকে দিয়েছিলেন ‘দাদু’ রবীন্দ্রনাথকেও! বাবা ও মা দু’দিক থেকেই ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়া দেবিকা।
শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের নজরে পড়েন দেবিকা। মেয়ের সম্পর্কে তার বাবা কর্নেল মন্মথনাথ চৌধুরীকে কবিগুরু বলেছিলেন, ”তোমার কন্যেটি সূর্যমুখীর কুঁড়ি।” অর্থাৎ শুরু থেকেই একটা ‘স্পার্ক’ ছিল তাঁর মধ্যে। সেই ঝলমলে রূপ-লাবণ্য যে ভারতীয় সিনেমার আদিযুগে দর্শকদের মোহাবিষ্ট করবে তাতে আর আশ্চর্য কী! ইংল্যান্ডের বোর্ডিং স্কুলে ৯ বছর বয়স থেকে পড়ার অভিজ্ঞতা তাঁর আভিজাত্যে মোড়া ব্যক্তিত্বকে গোড়া থেকে ঝকঝকে করে গড়ে তুলেছিল। ১৯২৮ সালে আলাপ হিমাংশু রাইয়ের সঙ্গে। পরের বছর মুক্তি পেল ‘এ থ্রো অফ ডাইস’ (১৯২৯)। এই ছবির সেট ডিজাইন করতে গিয়েই হিমাংশুর সঙ্গে আলাপ দেবিকার। এরপরই গাঁটছড়া বাঁধেন তাঁরা।
তবে চলচ্চিত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ ‘কর্ম’ ছবির মাধ্যমেই। কেবল চুম্বন দৃশ্যই নয়, সামগ্রিক ভাবে রুপোলি পর্দায় তাঁর উপস্থিতি দর্শকদের মন জিতে নিয়েছিল। তবে জানা যায়, খ্যাতি মূলত ইংল্যান্ডেই পেয়েছিলেন। ভারতে ‘নাগিন কি রাগিনী’ নামে মুক্তি পাওয়া ছবিটি সেভাবে আসর জমাতে পারেনি। কিন্তু দেবিকা মোটামুটি পরিচিত পেয়ে যান তখনই। ১৯৩৪ সালে স্থাপন করলেন বম্বে টকিজ। স্বামীর সঙ্গে জুটি বেঁধে তৈরি সেই প্রযোজনা সংস্থার প্রথম ছবির নাম ‘জওয়ানি কি হাওয়া’ (১৯৩৫)। আর সেই ছবিতেই নাজম-উল-হুসেন ছিলেন তাঁর বিপরীতে। প্রেমের সেই শুরু। যা ক্রমেই গনগনে আঁচে ফুটতে থাকে। এদিকে ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘জীবন নাইয়া’ ছবির কাজ। আর সেই ছবির সেটে আরও কাছাকাছি চলে এলেন তাঁরা। হিমাংশু রায় কিছুই টের পাননি। লখনউয়ের রাজপরিবারের বংশধর নাজমের প্রেমে দিগ্বিদিক ভুলেছেন স্ত্রী। আচমকাই খবর পেলেন, দু’জনে পালিয়ে গিয়েছেন!
আকস্মিক এমন আঘাতে তিনি পর্যদুস্ত হয়ে পড়লেন। এই সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন শশধর মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বম্বে টকিজের সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। দু’জনে মিলে রওনা দিলেন কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেল অভিমুখে। শেষপর্যন্ত দেবিকা ফিরলেন হিমাংশুর কাছে। নাজম বাদ পড়লেন। তাহলে নায়ক কে হবে? হিমাংশু ছিলেন রীতিমতো সুদর্শন। কিন্তু প্রযোজনার ভার সামলে অভিনয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর সেই কারণেই বাছতে হয়েছিল নাজমকে। তাহলে এবার কে?
কুমুদ নামের এক যুবকের কথা উঠল আলোচনায়। তাঁর তখন বছর পঁচিশেক বয়স। কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাটা পেড়েছিলেন শশধরই। তিনিই যে তাঁর জামাইবাবু। ল্যাবের চাকরি ছেড়ে কুমুদ ‘অশোক কুমার’ হয়ে প্রবেশ করলেন রুপোলি পর্দার আশ্চর্য জগতে। ‘জীবন নাইয়া’ সুপারহিট। পরের ছবি ‘অচ্ছ্যুৎ কন্যা’ রীতিমতো হইহই ফেলে দিয়েছিল। অশোক কুমার হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় নায়ক। অথচ অশোক কুমার পরপর হিট ছবি করে গেলেন দেবিকার বিপরীতে। ‘জীবন প্রভাত’, ‘নির্মলা’, ‘দুর্গা’… তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ। পরবর্তী সময়ে ‘কিসমত’-এর মতো ছবি অশোক কুমারকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন সুপারস্টার। অথচ তাঁর সাফল্যের নেপথ্যে থেকে গেল ‘কিসমত’-এরই খেল! দেবিকা-নাজমের প্রেমকাহিনি। যা না ঘটলে নায়ক বদলের সম্ভাবনাই তৈরি হত না।
হিমাংশু রায়ের প্রয়াণের বম্বে টকিজের দায়িত্ব নেন দেবিকাই। অশোকের ‘কিসমত’-এর মতো ছবির প্রযোজনা করেছিলেন তিনি। এদিকে রুপোলি পর্দার নায়িকা হিসেবে ‘হামারি বাত’ (১৯৪৩) ছিল তাঁর অভিনীত ছবি। ক্রমে রুপোলি পর্দাকে একবারেই বিদায় জানান। কেননা শশধর ও অশোক কুমার আলাদা করে তৈরি করেছিলেন নতুন স্টুডিও ‘ফিল্মিস্তান’। এই ‘রাজনীতি’ই তাঁকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল ফিল্মি দুনিয়া থেকে। তবে সে অন্য গল্প। এতগুলো বছর পরও টিকে গিয়েছে দেবিকার মিথ। বলিউড আজও ভোলেনি তাঁকে। সৌন্দর্যের সঙ্গে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের এমন মিশেল যে সত্যিই অবিস্মরণীয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.