অর্ণব আইচ: “এতটা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে বারণ করেছিলাম। চিৎকার করে থামতে বলেছিলাম। ভিক্টো শোনেনি”, এবার ঠাকুরপুকুর কাণ্ডে খুনের ঘটনায় টলিউড পরিচালক সিদ্ধান্ত দাস ওরফে ভিক্টোর বিরুদ্ধে লালবাজারের গোয়েন্দাদের কাছে বয়ান দিলেন তাঁরই দুই বান্ধবী ঋ এবং শ্রিয়া বসু। আর সেই প্রেক্ষিতেই তাঁদের বয়ানকে গুরুত্ব দিয়ে সময়ের অনেক আগেই ভিক্টোর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট পেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা।
সিদ্ধান্ত ওরফে ভিক্টোর গ্রেপ্তারির পর থেকে টলিপাড়া থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকের মনেই প্রশ্ন, তিনি কি আদৌ শাস্তি পাবে? নাকি বাকিদের মতো নিজের প্রভাব খাটিয়ে জামিনে মুক্তি পেয়ে যাবেন? তবে পুলিশ সূত্রের খবর, এই মাসেই ভিক্টোর বিরুদ্ধে খুন ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে আলিপুর আদালতে চার্জশিট পেশ করতে পারে পুলিশ। সে রীতিমতো ‘সজ্ঞানে’ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে খুন ও খুনের চেষ্টা করেছে, এমন তথ্যও চার্জশিটে উল্লেখ করা হতে পারে বলে জানা গিয়েছে। সেই ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ও বয়ান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিক্টোর গাড়িতে থাকা দুই বান্ধবী ছাড়াও এই ‘দুর্ঘটনা’য় আহত ব্যক্তি এবং ঠাকুরপুকুর বাজারে উপস্থিত অনেকেই পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
৫ এপ্রিল ভিক্টো পরিচালিত ধারাবাহিক ‘ভিডিও বৌমা’র সাফল্য উদযাপন করতে অভিনেতা, অভিনেত্রীদের নিয়ে রাতভর পার্টি করেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন ধারাবাহিকের নায়ক আরিয়ান ভৌমিক, অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেন, কার্যনির্বাহী প্রযোজক শ্রিয়া বসু, অভিনেতা স্যান্ডি সাহা। প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রবিবার সকালে মদ্যপ ভিক্টো গাড়ি চালিয়ে সোজা ঢুকে পড়েন ঠাকুরপুকুর বাজারের জনবহুল এলাকায়। একের পর এক দোকান ও পথচারীকে ধাক্কা দিতে থাকে তার গাড়ি। আর তাতেই মৃত্যু হয় আমিনুর রহমান নামে জনৈক পথচারীর। যিনি বাকরাহাটের বাসিন্দা। ভিক্টোর গাড়ির ধাক্কায় আহত হন আরও অন্তত আটজন। তারপর থেকেই উত্তাল গোটা টলিপাড়া। ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সকলে। অভিযুক্তের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে আমজনতাও। যখন এই ঘটনাটি ঘটে, তখন ভিক্টোর গাড়িতে ছিলেন তাঁরই দুই বান্ধবী অভিনেত্রী ঋ এবং এক নামী চ্যানেলের কার্যনির্বাহী প্রযোজক শ্রিয়া বসু। লালবাজারের সূত্র জানিয়েছে, কিছুদিন আগেই ঋ ও শ্রিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁদের বয়ান রেকর্ড করা হয়। যেহেতু তাঁরা ভিক্টোর সঙ্গে গাড়ির ভিতর ছিলেন, তাঁদের বক্তব্য চার্জশিট পেশ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাঁদের বক্তব্যে উঠে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাঁরা উভয়েই আলাদাভাবে গোয়েন্দা আধিকারিকদের জানান যে, তাঁরা একসঙ্গেই প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার একটি পানশালায় মদ্যপান করেন। সেখান থেকে বিষ্ণুপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে যান। সেখানেও সারা রাত ধরে তাঁরা সবাই মিলে নেশা করেন। ওই অবস্থায় ভিক্টো গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, প্রথমবার স্কুটারে ধাক্কা দেওয়ার সময় সামনে অন্য একটি গাড়ি চলে এসেছিল। দুই পথচারী ভিক্টোর গাড়ির বেপরোয়াভাব দেখে পালিয়েও যান। সেই কারণে ভিক্টো গতি একেবারে কমিয়ে দিয়ে অন্য গাড়িটিকে কাটিয়ে কিছুটা এগিয়ে যায়। এর পরই ফের গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয় সে। লালবাজার জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিচালক ভিক্টোর বিরুদ্ধে গিয়েই তাঁর দুই বান্ধবী ঋ ও শ্রিয়া বয়ান দিয়েছেন যে, যখন প্রথমবারের জন্য ধাক্কা দিয়ে ভিক্টো গাড়ি থামিয়ে দেয়, তখনই তাঁরা দুজনই তাঁকে থেমে যেতে বলেছিলেন। তাঁরা রীতিমতো ভয় পেয়েই ভিক্টোকে বলেছিলেন, “আর গাড়ি চালাস না। এখানেই থামিয়ে দে।” পুলিশের কাছে ঋ ও শ্রিয়ার দাবি, তাঁরা গাড়ির ভিতরে বসেই চিৎকার করে ভিক্টোকে বাজারের মধ্যে গাড়ি চালাতে বারণ করেন। কিন্তু ভিক্টো কর্ণপাত করেনি। ভিক্টো বান্ধবীদের বলে, ঠাকুরপুকুর বাজার তার নিজের এলাকা। এই বাজারের ভিতর সে নিজের ইচ্ছামতো বেপরোয়াভাবেই গাড়ি চালায়। তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। যা ইচ্ছা সে করতে পারে। দুই বান্ধবীর কাছে এই দাবি তুলে সে ফের গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়বার গাড়ির গতি বাড়িয়ে সে দুজনকে ধাক্কা দেয়। তাঁদের আহত হতে দেখে ফের দুই বান্ধবী ভিক্টোকে গাড়ি চালাতে বারণ করেন। কিন্তু সেই অনুরোধে কান না দিয়ে ফের আরও জোরে গাড়ি চালানো শুরু করে সে।
পুলিশের দাবি, এভাবে অন্তত পাঁচবার গতি বাড়িয়ে ধাক্কা দেওয়ার পর এক পথচারীকে ধাক্কা দেয়, যিনি তার গাড়ির তলায় ঢুকে যান। অভিযোগ, জেনেশুনে তোয়াক্কা না করেই ওই পথচারীকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে প্রায় ৩০ মিটার নিয়ে যায় সিদ্ধান্ত দাস ওরফে ভিক্টোর গাড়ি। শেষ পর্যন্ত একটি স্কুটিকে ধাক্কা দেওয়ার পর সেই স্কুটি গাড়ির চাকার তলায় ঢুকে গেলে সেটি থেমে যায়। না হলে ভিক্টোর গাড়ির ধাক্কায় আরও কয়েকজন পথচারী আহত হতে পারতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.