বিশ্বদীপ দে: ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়।’ ২৫ জুন ১৯৭৫ সাল। অল ইন্ডিয়া রেডিওয় শোনা গিয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর, ”রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।” সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে তৈরি হল এক অস্থিরতা। এর ঠিক মাস দেড়েকের মধ্যেই মুক্তি পেল একটি হিন্দি ছবি। নাম ‘শোলে’! আপাত ভাবে মনে হতেই পারে সমাপতন। কিন্তু স্রেফ এইটুকুই সম্পর্ক নয় এই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ‘ইস্যু’র মধ্যে। প্রথমটিকে কংগ্রেস-বিরোধীরা ভারতীয় রাজনীতির ‘কালো অধ্যায়’ বলে দাবি করেন আজও। দ্বিতীয়টি সর্বকালের সেরা বলিউড ব্লকবাস্টার। কিন্তু গত শতকের সাতের দশকের সেই সময়কাল মিলিয়ে দিয়েছিল এই দুইকে।
এবছর ‘শোলে’ পা দিচ্ছে পঞ্চাশ বছরে। পাঁচ দশক ছুঁয়ে আজও ধিকি ধিকি জ্বলছে সেই আগুন! অথচ গোড়ায় এই ছবি প্রযোজনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বোম্বের (তখন এই নামেই ডাকা হত) একাধিক প্রযোজক। অথচ সেলিম-জাভেদ ততদিনে ‘রাজত্ব’ কায়েম করে ফেলেছেন। মাত্র চার লাইনের একটা স্টোরি আইডিয়া ছিল তাঁদের কাছে। দীপ্তকৃতি চৌধুরীর ‘রিটেন বাই সেলিম-জাভেদ: দ্য স্টোরি অফ হিন্দি সিনেমাস গ্রেটেস্ট স্ক্রিনরাইটার্স’ বইয়ে রয়েছে সেই সংক্ষেপসার। পরিবারের সকলকে হারাতে হয়েছে প্রাক্তন এক আর্মি অফিসারকে। সেই সময় তার মনে পড়ছে দুই জুনিয়র অফিসারকে। তারা নিতান্তই ‘রাস্কেল’। কিন্তু সাহসী। অবসরপ্রাপ্ত সেই অফিসার বদলা নিতে কাজে লাগাবে ওই দুই তরুণকে। এইটুকুই স্টোরিলাইন। শেষপর্যন্ত চার লাইনের এই প্লটই বিক্রি হয় দেড় লক্ষ টাকায়। ‘সিপ্পি ফিল্মস’-এর কাছে। এরপর প্রযোজনা সংস্থার অফিসের এক ছোট্ট ঘরে বসে কাহিনিটি লিখতে শুরু করেন সেলিম-জাভেদ। বলাই বাহুল্য, লিখতে লিখতে সেনা অফিসার হন পুলিশ অফিসার। জুনিয়র অফিসাররা হয়ে যান নিতান্তই ছিঁচকে চোর।
কিন্তু ‘শোলে’র গল্প কি পুরোপুরি মৌলিক? তা অবশ্যই বলা যায় না। কুরোসাওয়ার ‘সেভেন সামুরাই’, জন স্টার্জেসের ‘দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট সেভেন’ তো বটেই, এমনকী ১৯৭১ সালের বলিউড ছবি ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’ থেকেও আইডিয়া গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। শেষোক্ত ছবিতে ভিলেন ছিলেন বিনোদ খান্না। তাঁর চরিত্রের নাম ছিল ‘জব্বর সিং’! ছবিটি যখন তৈরি হচ্ছে, ততদিনে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে ‘খোটে সিক্কে’। সেই ছবিও পাঁচ ‘ছিঁচকে’ অপরাধীকে ভাড়া করে বদলা নেওয়ার গল্পই। কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই, ট্রিটমেন্টে ‘শোলে’ এই দুই হিন্দি ছবিকে মাত করে দিয়েছিল। খরচে কোনও কার্পণ্য করেননি সিপ্পিরা। রীতিমতো নকল একটি গ্রামই বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। পর্দায় যাকে আমরা রামগড় বলে জানি।
যে কোনও সফল ছবির কথা উঠলে নায়ক-নায়িকা, হিট গান এবং সংলাপই মূলত লোকের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু ‘শোলে’ এমন এক ছবি, যার ছোট ছোট চরিত্ররাও কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে একটিই সংলাপে। ‘সর্দার, পচাশ হাজার’… সংলাপ ছিল ম্যাকমোহন অভিনীত সাম্ভা চরিত্রটির মুখে। কিংবা বিজু খোটে অভিনীত কালিয়ার আকুতি ‘ম্যায়নে আপ কা নমক খায়া হ্যায়’। অথবা একে হাঙ্গল অভিনীত রহিম চাচার মুখে ‘ইতনা সান্নাটা কিঁয়ু হ্যায়?’ হাঙ্গল সাহেবের চরিত্রটি তো ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাকি দুজনের গুরুত্ব সামান্যই। তবু তাদের সংলাপ এখনও উচ্চারিত হয় জনমানসে। ‘সুরমা ভুপালি’ জগদীপ, ঘোড়া ‘বাসন্তী’ থেকে ‘আংরেজো কা জমানা কা জেলার’ আসরানিও সামান্য পরিসরেই অমরত্ব লাভ করেছেন। কোনও ছবির সাফল্যের শিকড় কত গভীরে সেটা বোঝাতে এই উদাহরণগুলোই বোধহয় যথেষ্ট।
অথচ ছবি বানাতে গিয়ে প্রতি পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়েছিল। গব্বর সিং করার কথা ছিল ড্যানির। কিন্তু তাঁর তখন ‘ডেট’ নেই। সেই সময় জাভেদ আখতারের মনে পড়ে কয়েক বছর আগে দেখা এক নাটকের কথা। সেখানে ‘জনৈক’ আমজাদ খানকে তাঁর মনে ধরেছিল। কিন্তু সেই অভিনেতার গলা যে বড্ড সরু। ডাকাতের সর্দারের গলায় যে দার্ঢ্য দরকার, তা অনুপস্থিত। কে জানত, গব্বরের ওই কণ্ঠস্বরই চরিত্রটিকে অন্য ডায়মেনশন দেবে!
ছবি তৈরি হতে হতে দেখা যায় ধর্মেন্দ্র বীরু বড্ড ‘ফ্ল্যাট’। চরিত্রটিকে আরও মজাদার করা দরকার। তখনই পরিকল্পনা করা হয় ‘সুসাইট’-এর (বীরু এভাবেই উচ্চরণ করেছিল) দৃশ্যটি। অথচ দৃশ্যটি কিছুতেই লেখা হচ্ছিল না। বলা যায়, কেমন এক কুঁড়েমিতেই জাভেদ আখতার সেটি লিখে উঠতে পারেননি। শেষপর্যন্ত গাড়ির বনেটে কাগজ রেখে তিনি দৃশ্যটি লিখেছিলেন ফেরার ফ্লাইট ধরার ঠিক আগে! অথচ ভারতীয় মশলা ছবির ইতিহাসে এ এক ‘আইকনিক’ মজার দৃশ্য।
এখানেই শেষ নয়। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই মনখারাপ পরিচালক-কলাকুশলীদের। এমন বিরাট স্টারকাস্ট, এমন বিপুল বাজেট… তবু ছবি চলছে না! পেরিয়ে গেল দুই সপ্তাহ। তাহলে কি ছবি ফ্লপ? সেলিম-জাভেদ সেই সময় কাগজে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করেন, এই ছবি হিট হবেই। গ্যারান্টি! কেবল হিটই হবে না রোজগার করবে এক কোটি টাকা! পরে দেখা যায়, হিসেবে ভুল হয়েছে তাঁদের। কেননা ছবিটি ব্যবসা করেছিল এক নয়, তিন-তিন কোটি! অথচ অমিতাভ বচ্চনের মৃত্যুদৃশ্যটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অন্যতম প্রোটাগনিস্টের মৃত্যুই দর্শককে হলমুখী করছে না বলে মনে করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল ছবির ক্লাইম্যাক্সের ঠিক আগের ওই দৃশ্য নতুন করে শুট করা হবে। ভাগ্যিস হয়নি। অমিতাভের মৃত্যুর ‘ট্র্যাজেডি’র পরই ধর্মেন্দ্রর ‘চুন চুন কে বদলা’ নেওয়ার দৃশ্যকে এমন প্রভাব ফেলতে পেরেছিল দর্শকের মনে। ‘উইশ ফুলফিলমেন্ট’ যে কোনও নিখাদ বাণিজ্যিক ছবির সাফল্যেরই শেষ কথা বোধহয়।
এবার আসা যাক লেখার শুরুতে উল্লিখিত ‘এমার্জেন্সি’ প্রসঙ্গে। তৎকালীন ভারতের সেন্সর বোর্ড সিপ্পিদের বাধ্য করেছিল ছবির ক্লাইম্যাক্স বদলাতে। ‘শোলে’র একেবারে শেষে দেখা যায় ঠাকুর ও গব্বরের দ্বৈরথ। আর সেই দ্বৈরথ শেষে ঠাকুর সাব পুলিশের হাতেই তুলে দেন গব্বরকে। কিন্তু প্রথমটা এমন ছিল না মোটেই। দেখানো হয়েছিল, গব্বর প্রাণ হারাচ্ছে ঠাকুরের হাতে। এতে ঘোরতর আপত্তি ছিল সেন্সর বোর্ডের। সেই ‘এমার্জেন্সি’র দিনে এভাবে আইনকে হাতে তুলে নেওয়া দেখানো যাবে না বলে নিদান দেওয়া হয়। অগত্যা ফের ২৬ দিন ধরে শুট করা হয় বিকল্প ক্লাইম্যাক্স। প্রাণে বেঁচে যায় গব্বর।
‘জরুরি অবস্থা’র দিনগুলো ভারতীয়দের একেবারে ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছিল। সেই আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ‘শোলে’ হয়ে উঠেছিল মহৌষধ। আমজনতাকে ‘দু-দণ্ড শান্তি’ দিয়েছিল রামগড় নামের জনপদটি। তৈরি হয়েছিল এক কাল্ট ক্লাসিক। যাকে নিয়ে আলোচনা আজও অব্যাহত। ভবিষ্যতেও থাকবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.