Advertisement
Advertisement
Drama review

হারিয়ে ফেলা আকাশ ও জানালার খোঁজে ‘ইচ্ছেমতো’

সৌরভ পালোধির এই নাটক নির্মল আকাশ দেখার বন্ধ জানলাগুলো খুলে দিল।

Sourav Palodhi Icchemoto's new drama review
Published by: Sandipta Bhanja
  • Posted:June 12, 2025 4:03 pm
  • Updated:June 14, 2025 12:50 pm  

নির্মল ধর: সৌরভ পালোধির নাট্যদল ‘ইচ্ছেমতো’র নতুন প্রযোজনা ‘যে জানালাগুলোর আকাশ ছিল’ দেখার পর অতীতচারি না হয়ে উপায় নেই। হ্যাঁ, অনেকেই বলতে পারেন অতীত নিয়ে শুধু গর্ব করে বর্তমানকে সরিয়ে রাখা কি জীবন? না, নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু বর্তমান যদি জীবনের শিকড়ে বাঁচার জন্য অতীতের মতো খোলা মনের হাওয়া,নীল আকাশ, বুক চিতিয়ে একের বিপদে আপদে অন্যের কোমল স্নেহে হাতের ছোয়া না পায়, তখন আবার ছোটবেলায় মন ফিরতে চাইলে অপরাধ কোথায়? একসময় শহরের প্রান্তিক কলোনি এলাকাগুলো এখন হয়েছে ‘উত্তরণ’, আর শহর পরিণত হয়েছে আকাশছোয়া ফ্ল্যাট বাড়ির হাইটেক বসতিতে! উত্তরণে উত্তীর্ণ হওয়া কলোনির পুরোনো দিনের হারিয়ে ফেলা জীবন নিয়ে বেশ কয়েকটি স্মৃতিচারণ মূলক লেখা সৌরভ পালধীর নাটকের উৎস।

Advertisement

সত্যি বলতে কী, কলকাতার দক্ষিণে ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু নিয়ে গড়ে ওঠা বিজয়গড়, আজাদগড়, গান্ধি কলোনিগুলোই একটা সময় ছিল এই রাজ্যের বামপন্থী চিন্তাভাবনার আঁতুড়ঘর! আবার একই সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ক্লাবগুলোর সমর্থকদের মিষ্টি ঝগড়ার আখড়াও। আশি নব্বইয়ের দশক ছিল ঘটি-বাঙালের কড়া-মিঠে সম্পর্কের এক সন্দেশ। সৌরভের নাটকের চারটি প্রধান চরিত্র টুবাই (রাহুল), বুবান (বুদ্ধদেব), তাতিন (কৃষ্ণেন্দু) আর সোমা (তূর্ণা) এইসব কলোনির প্রায় সমবয়সী বন্ধু। প্রথম দিকে কৌশরকালের আগে তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল হাসি ঠাট্টা, মজা আর গানের কলিতে ভরা। নজরুলের গান ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে..’ শুনে তাঁরা চার জনেই নাচে, হাসে। বন্ধুত্বের মধ্যে বড়দের মলিন ভাবনা তখনও ছায়া ফেলতে পারেনি। বড্ড নির্মল পবিত্র ছিল সেই সময়গুলো। কিন্তু কালের নিয়মেই বয়স বাড়ে, চিন্তায় ঢুকে পড়ে বাঁচার লড়াইয়ের সমস্যা। আসে রাজনীতিও। পাড়ার পুজোয়, দোলে, বিপদে আপদে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েও বটে, কিন্তু কোথায় যেন পবিত্র ছোটবেলাটা হারিয়ে যেতে থাকে। রাজ্যে রাজনীতির চেহারাও বদলাতে থাকে। বামফ্রন্ট সরে যায়। এবং এই চারজনের মধ্যেও কোথায় যেন মানসিকতায় চিড় ধরে। সোমাকে নিয়ে সেই কলেজ কাল থেকেই টুবাই ও বুবানের একটা চাপা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলই। সেটা সাময়িক ভাবে দূরে সরে যায় সোমার বাবা ত্রিপুরায় বদলি হয়ে গেলে। বুবান অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। বড় হয়ে সে সিরিয়ালের কাজে ব্যস্ত। সিপিএম করার জন্য নয়, টুবাই নিজের যোগ্যতায় একটা চাকরি পায়। আর বাবার মৃত্যুতে সোমা ফিরে এলে সে আবার সিপিএম দলের সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠে। আর তাতিন নাম লেখায় শাসক দলের খাতায়। সে এখন মদ্যপ বাবার অত্যাচার থেকে মাকে নিরাপদে রেখেছে। এই চারজন এখনও বন্ধু, অথচ কোথায় যেন ‘বড়’ হয়ে ওঠার কাঁটা তাদের মাঝে বিচ্ছিন্নতার একটা বেসুর বাজিয়ে চলে চোরাস্রোতের মতো। আকস্মিকভাবে অন্য শহরে থাকা টুবাই এর মৃত্যুর খবর এলে সিরিয়াল অভিনেতা বুবান অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যায়। চোখে গ্লিসারিন দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতেও পারেনা। সোমা শুধু বলে ওঠে ‘ঠিক আছে’, যেমনটি সে অতীতে বলেছিল বুবানকে প্রথম প্রেম নিবেদন করার সময়! সোমা জড়িয়ে থাকে সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের পথে, রাস্তার আন্দোলনে। এবং সে নীরব প্রেমিক বুবানকে বলে- “আমি জিতব কি হারব জানি না, কিন্তু জীবনের সংগ্রাম থেকে পলাতকের তালিকায় আমার নামটা অন্তত থাকবে না। দেখা হবে হয়তো আবার কোনোদিন এই রাস্তায়।” এই প্রযোজনা সত্যিই কলকাতা শহরে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক নির্মল বন্ধুত্বের কথা দেখায় এবং বলে। রাজনীতির কলুষ সেই বন্ধুত্বকে স্পর্শ করতে পারেনি।

এমনিইতো আমরা ছিলাম, নাটক দেখার পর প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কেনো এমন ভাবে আমরা এখন আর বাঁচতে পারিনা! সৌরভ পালোধি শুধু বক্তব্যে এমন এক বাতাবরণ তৈরি করে ক্ষান্ত হননি, তিনি ইঙ্গিত রেখেছেন বাঁচার আরেক নাম সহমর্মিতা, সহযোগিতা, প্রাত্যহিক জীবনের জানালাগুলো খুলে রেখে বিশাল আকাশ দেখার জন্য মনকে তৈরি করা। এবং এমন একটি পজিটিভ বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর নাট্য নির্মাণ কৌশল ও শৈলী সত্যিই চোখ ভরে দেখার মতো। নুন্যতম প্রপস্ দিয়ে মঞ্চ সাজানো শুধু নয়, নাটকটির নির্মাণে তিনি যেভাবে মানুষের ছোট ও বড় বেলাকে একই সঙ্গে মঞ্চে এনেছেন, সেটা আমরা সিনেমাতেও বড় একটা দেখিনি।

তিন বন্ধুর ছোটবেলায় অভিনয় করেছে একটিই কিশোর ঋদ্ধায়ন দাশগুপ্ত। তাকে কিন্তু বড় টুবাই, বুবান ও তিতানের সঙ্গে একই সময়ে মঞ্চে রাখা হয়েছে। এমনকী ওঁরা কিছু সংলাপও বলেছে প্রায় একই সঙ্গে। ছোট সোমা (মেঘাত্রী মন্ডল)ও সঙ্গী হয়েছে তাদের। ছোটো ও বড় দুই চরিত্রের শিল্পীকে একই সঙ্গে মঞ্চে রেখে সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা অবশ্যই বাড়তি বাহবাযোগ্য। এই নাটকে পুরোনো বাংলা ও হিন্দি সিনেমার গানের কী অনিন্দ্যসুন্দর ব্যবহার, না দেখলে বোঝানো যাবে না। এমনকি দেবদীপের লেখা ও ঋষি পণ্ডার গাওয়া গানটি যেন ফিরিয়ে আনে সেই হারানো সময় ও দিনের আবহ। অভিনয়ে সবার আগে রাহুল অরুণোদয়ের (টুবাই) নামটাই করছি, তাঁর অভিনয়ে নাটুকেপনা কম, সিনেম্যাটিক অভিনয় বেশি। কিন্তু মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমানে পাল্লা দিয়েছেন বুবান চরিত্রের শিল্পী বুদ্ধদেব দাস। বেশ দাপট আছে তাঁর অভিনয়ে আবার প্রয়োজনে তিনি নীরবও হতে পারেন। একটু বেশি হয়ে গেলেও আচমকা টুবাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁর বাকরহিত হয়ে পড়া, চোখে গ্লিসারিন লাগিয়েও কাঁদতে না পারার অভিনয়টা সত্যিই নজর কারে। তাতিনের ভূমিকায় কৃষ্ণেন্দু সাহা বেশ স্বাভাবিক ও সহজ। তূর্ণা দাস হয়েছেন সোমা। অভিজ্ঞ শিল্পী তাঁর নিজস্বতা দিয়েই গড়েছেন সোমাকে। বেশ আন্তরিক চরিত্রায়ন তাঁর। আর রয়েছেন প্রবীণ বিমল চক্রবর্তী, বুবানের বাঙালভাসি দাদুর চরিত্রে। তাঁকে মঞ্চে আর চ্যালেঞ্জ জানাবে কে? তাঁর উপস্থিতি সত্যিই সেই পুরনো সময়ের এক দলিল, খানিকটা ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে বিজন ভট্টাচার্যের মতো। এখনকার এমন বিচ্ছিন্নতার সময়ে দাঁড়িয়ে সৌরভ পালোধির এই নাটক পুরোনো নির্মল নীল আকাশ দেখার বন্ধ জানলাগুলো যেন অনেকদিন পর খুলে দিল।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement