বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: শাহরুখ খান বলেছেন, ‘হারকে জিতনেওয়ালোকো বাজিগর ক্যাহতে হ্যায়!’ কোনটা হার আর কোনটা জিত? ধরা যাক যাদের প্রতিযোগী করে মাঠে নামানো হল, তারা এসব নিয়ে ভাবছেই না। তারা কেবল খেলতে চায়। যে দল বেশি স্কোর করে কাপ পেল, তাদের নিয়ে উৎসব করছে সেকেন্ড রানার আপ ! তাহলে কী সর্বনাশ হবে ভাবুন তো। এই যে পুঁজিবাদী সমাজের নতুন নতুন কম্পিটিশনের ফাঁদ, সেসব আর ধোপে টিকবে না। এ যেন এক ইউটোপিয়ান পৃথিবী যেখানে বিভাজনের খেলা চলে না। কোনটা নরমাল আর কোনটা অ্যাবনরমাল সেটাও এই ইউটোপিয়ান পৃথিবীতে আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের পৃথিবীতে এটা কে কবে ঠিক করেছিল? এটাও বোধহয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই শুরু হয়েছিল। বেশির ভাগ মানুষ যা করে, যেভাবে নিজেদের চালনা করে সেটাই ঠিক, সেটাই নরমাল। সেটা জেনে এবং মেনেই এতগুলো বছর পার করে দিয়েছি। কিন্তু এখন চারপাশে যেভাবে মানুষ ভাবছে, যেভাবে কথা বলছে, যা বিশ্বাস করছে তাতে হিসেবটা অনেকদিন হল গুলিয়ে গিয়েছে।
আমির খান অভিনীত ছবি ‘সিতারে জমিন পর’, সেই বিশ্বাসের জায়গাটা আরও একবার মনে করিয়ে দিল। আর. এস. প্রসন্ন পরিচালিত এই ছবি স্প্যানিশ ছবি campeones(চ্যাম্পিয়ন) -এর অফিসিয়াল রিমেক। হলিউডেও এর আরেকটি ভার্সান আছে। আমি কোনওটাই দেখিনি। ‘লাল সিং চাড্ডা’-র প্রায় তিন বছর পর তিনি ফিরলেন। সঙ্গে দশজন ডেবিউ অভিনেতা যারা বিশেষভাবে সক্ষম। ‘তারে জামিন পর’-এ আমরা দেখেছি এক ডিসলেক্সিক ছাত্রকে কিভাবে দিশা দেখিয়েছিলেন তার স্কুলের স্যর। এখানে সেই স্যর বাস্কেটবল কোচ এবং সঙ্গে তার বিশেষভাবে সক্ষম দশ ছাত্র।
গল্পে যে খুব অভিনবত্ব আছে এমন নয়। বলিউড স্পোর্টস ফিল্ম ঠিক যা যা মশলা, যে ইমোশন বেশি মাত্রায় উস্কে দিয়ে তৈরি হয়, এখানে তার অন্যথা হয়নি। দিব্য নিধির চিত্রনাট্য সেই চেনা অলি গলি দিয়েই হাঁটে। আমার নরমাল আর তোমার নরমাল যে এক নয়, এবং কেন নয় সেই নিয়ে বলিউডি কায়দায় জ্ঞান দেওয়া আছে। সিনেমায় যে কথা দৃশ্য-ভাবনা দিয়ে বলা যায় সেটা সটান সংলাপে বসিয়ে দিলে শুনতে যে ভালো লাগে এমন নয়। দর্শককে আন্ডারএস্টিমেট করলে সেটা করতে হয়, যদি দর্শক না বোঝে। কিন্তু এই ছবিতে যে ‘নরমাল’ অর্থাৎ কোচ গুলশন খান ( আমির খান ) তার বিচ্যুতিগুলো অত প্রকট করে বলা হয়নি, সেটা দর্শক দেখতে দেখতে বুঝেছে। গুলশন ইগোইস্টিক, পিটিএসডি-র শিকার, প্রাচীনপন্থী, ভালো মানুষ হলেও সংবেদনশীল নয়, একগুঁয়ে। তার মনের যত্ন দরকার। কিন্তু আমাদের সমাজে পুরুষ মানেই স্ট্রং। এই ভুল ন্যারেটিভের শিকার প্রায় সব পুরুষ। গুলশনও তাই! স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে, কীভাবে মেটাতে হয় জানে না। তার দলের ছোট মেয়েটা দেখিয়ে দেয় , সরি বলা কত সহজ! বিশেষ ভাবে সক্ষম কথাটা যেন আক্ষরিক অর্থেই সত্যি! গলু তার স্যারকে বলে , প্রতিযোগীকে অসম্মান করতে নয়, তারা জিততে এসেছে। আমাদের চারপাশে মানুষ মনে করে কাউকে টেনে না নামালে ওপরে ওঠা যায় না। আমাদের পৃথিবীতে সকলের সঙ্গে সকলের অদৃশ্য প্রতিযোগিতা।
পুঁজিবাদ আর ভোগবাদ আমাদের জীবনের ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্ত, সহজতা কেড়ে নিয়েছে বহুদিন। বদলে দিয়েছে বেঁচে থাকার টার্গেট। জীবনের প্রতিটি লগ্নে, প্রতি মুহূর্তে ঠেলে দিচ্ছে এক অসম প্রতিযোগিতার দিকে। যে ভাবছে সে হেরে যাচ্ছে, সে হেরে যাচ্ছে, যে ভাবছে সে জিতে গেল আসলে সেও হেরে যাচ্ছে। এ এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ যার মধ্যে আমরা সবাই আশ্রয় খুঁজে চলেছি। নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি, আশেপাশের মানুষদেরও। আর এইখানেই কোথাও আলাদা হয়ে যায় এই ছবির প্লেয়াররা। এই ছবিতে কোচ আসলে ওরাই। ছাত্র হল ওদের স্যার। উজ্জ্বল আমিরি উপস্থিতি সত্ত্বেও সিমরন মঙ্গেশকর, আয়ুষ বনশল, আশীষ পেন্ডসে, গোপী কৃষ্ণন ভার্মা, বেদান্ত শর্মা,আরৌষ দত্ত এবং অন্যরা মন জয় করে নিয়েছে। তবে আমির খান বয়স লুকনোর যতই চেষ্টা করুন সফল হননি। ছোট্ট চরিত্রে ভালো লাগে ব্রিজেন্দ্র কালা এবং ডলি আলুওয়ালিয়াকে। এই ছবিতে কোচ স্যারের কোচিং মুখ্য উদ্দেশ্যে হলেও আমার সবচেয়ে ভালো লাগল বাস্কেটবল ম্যাচের ফলাফল। প্রিয়া সিনেমায় অল্প সংখ্যক দর্শক থাকলেও তারা হাততালি দিয়ে সেই রেজাল্ট মাথা পেতে নিলেন। তবে এই ফলাফল বক্স অফিসে প্রভাব ফেলবে কিনা সেটা সময় বলবে ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.