সন্দীপ্তা ভঞ্জ: দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদের গৌরবগাথা বলিউডের পর্দায় নতুন নয়। সেদিক থেকে দেখলে, ‘কেশরী চ্যাপ্টার ২: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ জালিয়ানওয়ালাবাগ’ (Kesari Chapter 2: The Untold Story of Jallianwala Bagh) ছবিটির বিষয়বস্তুও ছকভাঙা নয়। তবে এই সিনেমা বলিউডের বক্স অফিসের মাইলস্টোন না হতে পারলেও অক্ষয় কুমারের ফিল্মি কেরিয়ারে একটা নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে বটে। কেন? প্রথমত, পরিচালক করণ সিং ত্যাগীর সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্ট। যা দর্শকদের এক লহমার জন্য চোখের পলক ফেলতে দেয় না। এবং দ্বিতীয়ত, আইনজীবী চেত্তুর সি শংকরণ নায়ারের ভূমিকায় অক্ষয় কুমারের দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স। ব্রিটিশরাজের নাগপাশে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হওয়া ভারতীয়দের ‘রবিনহুড’ হিসেবে যেভাবে পর্দায় ধরা দিলেন খিলাড়ি, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মামলা লড়তে গিয়ে শংকরণ নায়ার একা গোটা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে উলঙ্গ করে দিয়েছিলেন ভরা আদালতে। বইয়ের পাতায় বন্দি থাকা সেই ইতিহাস, দাপটের সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরলেন অক্ষয়। যেমন ঝাঁজালো বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, তেমনই রগরগে সংলাপে ‘বর্তমান প্রজন্মের মনোজ কুমার’ বুঝিয়ে দিলেন, ১৯১৯ সালের ‘খুনি বৈশাখী’র ১০৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ভারতের মনে আজও সেই ক্ষত দগদগে হয়ে রয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে ১৩ এপ্রিল যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারের দীর্ঘশ্বাসে আজও বাতাস ভারী হয়। আজও ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। ইংরেজদের সেই নির্লজ্জ কুকীর্তির জন্য নাইট উপাধি ত্যাগ করে ময়দানে দাঁড়িয়ে স্বকণ্ঠে এই কবিতা পাঠ করেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ। বিচার কিন্তু আজও অধরা। শতবর্ষ পেরলেও শ্বেতাঙ্গদের তরফে কেউ ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। আর ‘কেশরী চ্যাপ্টার ২’-তে সেকথা মনে করিয়েই কালি লেপে দিলেন অক্ষয়। হিন্দু-মুসলিম বিভাজন নীতি বহাল তবিয়তে থাকলে ফাক তালে ভারত শাসন-শোষণ করতে সুবিধে হবে, সেই ফন্দিতেই নির্বিচারে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ড ঘটিয়ে গোটা ভারতের সামনে ‘ভয়ের উদাহরণ’ তৈরি করার চেষ্টা করেছিল জেনারেল ও’ডায়ার। আর সেই রেজিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ারকেই ভরা সভায় যুক্তি-তক্কের মারপ্যাঁচে যিনি প্রায় নগ্ন করে ছেড়েছিলেন, তিনি চেত্তুর সি শংকরণ নায়ার। সেই ডাকসাইটে আইনজীবীর ভূমিকাতে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিলেন অক্ষয় কুমার (Akshay Kumar)।
একেবারে মেদহীন চিত্রনাট্য। দর্শকদের চোখ ভেজাতে কিংবা আবেগী করে তুলতে কোনও অতিরিক্ত দৃশ্য রাখেননি পরিচালক করণ সিং ত্যাগী। ইতিহাসের সিলেবাসে না পড়ানো ‘অজানা’ সব তথ্যে সাজানো ঝরঝরে চিত্রনাট্য। দেখতে বসে কোথাও একঘেয়ে লাগে না। তার কৃতীত্ব অবশ্য পরিচালক করণের পাশাপাশি প্রযোজক তথা চিত্রনাট্যকার অমৃতপাল সিং বিন্দ্রার। কোর্টরুম ড্রামায় ব্রিটিশদের হয়ে মামলা লড়া আইনজীবী নেভিলে ম্যাকেনলির চরিত্রে আর মাধবনের অভিনয় দেখলে দর্শকদের গা রি-রি করা অস্বাভাবিক নয়! শংকরণ নায়ারের সহ-আইনজীবী হিসেবে দিলরীত গিলের ভূমিকায় যথাযথ অনন্যা পাণ্ডে। আলিয়া ভাটের পর করণ জোহরের ‘দ্বিতীয় স্টুডেন্ট’-এর অভিনয় এখানে অনেকটা পরিণত। নায়ারের যোগ্য শিষ্যার ভূমিকায় অনন্যার পারফরম্যান্স প্রশংসার দাবিদার। ছবির প্রতিটা দৃশ্যে আবেগে মোচড় দেওয়ার জন্য যথাযথ আবহ সঙ্গীত। নেপথ্যের কারিগর শাশ্বত সচদেবের বাহবা প্রাপ্য। জানুয়ারি কিংবা আগস্ট মাসই যে শুধু নিজের দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার সময় নয়, এপ্রিলের ১৮ তারিখ বড়পর্দায় ‘কেশরী ২’ (Kesari Chapter 2) রিলিজ করে মনে করিয়ে দিলেন প্রযোজক করণ জোহর, করণ সিং ত্যাগী এবং অক্ষয় কুমাররা। আবারও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন শতবর্ষ আগের এক বৈশাখে নতুন বছরকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্বাগত জানিয়েছিল ‘রক্তাক্ত’ দেশ।
সিনেমার বেশ কিছু দৃশ্যে অক্ষয় কুমারের (Akshay Kumar) অভিনয় এই পরিসরে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হওয়ায় শৌচালয় ব্যবহার না করতে পারার অপমানে জ্বলে ওঠা চোখমুখ, আবার কখনও বা জেলবন্দি বিপ্লবী কৃপাল সিংয়ের পাঠানো ছেলে পরগতের খুনের নেপথ্য কাণ্ডের চিঠি পড়ার সময়ে চোখ ছাপিয়ে বীর সন্তানের জন্য অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য হোক কিংবা কোর্টরুমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশদের সামনেই তাদের রাজতন্ত্রকে রগরগে সংলাপে শাপ-শাপান্ত করার সিকোয়েন্স, সবক্ষেত্রেই আলো কেড়ে নিলেন অক্ষয় কুমার। অভিনেতার বছর খানেকের মন্দা কেরিয়ারের মোড় ঘোরাতে পারে ‘কেশরী ২’। শেষপাতে উল্লেখ্য, এমন পারফরম্যান্সের পরও যদি বক্স অফিসের মার্কশিটে খিলাড়ির নম্বরের খামতি থাকে, তাহলে হিন্দি সিনেমার দর্শকদের রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে দিনের শেষে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.