নির্মল ধর: ‘মার্কস ইন কলকাতা’- নাটকের এই নামটাই বাঙালি দর্শকের কাছে প্রথমে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করে। কিন্তু যখন জানা যায়, হাওয়ার্ড জিন নামের এক আমেরিকান নাট্যকার ১৯৯৯ সালে লিখেছিলেন ‘মার্কস ইন সোহো’ নামের এই প্রহসন নাটক, তখন বিশ্বাস হয় ‘মার্কস ইন কলকাতা’ তাহলে নিশ্চয়ই একই নাটকের বঙ্গিকরন। রবিবার বিড়লা সভাঘরের মঞ্চে কৌশিক সেনের পরিচালনায় ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’ এই নাটকটি নিউইয়র্ক বা লন্ডনের পরিচিত এলাকা সোহো থেকে দার্শনিক কার্ল মার্কসকে কলকাতার প্রেক্ষাপটে এনে নতুন ডাইমেনশন দিল। মার্কস তো আর জীবিত নন, সুতরাং তাঁকে নিয়ে যেমন রঙ্গ ব্যাঙ্গ করা যায়, তেমনই তাঁর রচনা ‘দাস ক্যাপিটাল’ ও ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ নিয়েও তর্ক না তোলারও কোনও কারণ নেই। জিনের নাটকের অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে অটুট রেখেই সেটিকে কলকাতা তথা বাংলায় ৩৪ বছরের বাম আমলের পটভূমিতে ফেলে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন কৌশিক সেন। আর এখানেই নাট্যকার কৌশিকের স্বার্থকতা।
আর এই ‘মার্কস ইন কলকাতা’ নাটকের মধ্য দিয়েই তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও নীতিহীন রাজনৈতিক দলের কথাও ছুঁয়ে গিয়েছেন। একটা প্রসঙ্গ এখানে মনে রাখা দরকার- কার্ল মার্কসকে কেন ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লন্ডন ঘুরে শেষপর্যন্ত নিউইয়র্কের সোহো পাড়ায় থিতু হতে হল? যাঁর লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে খোদ রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বীজ বোনা হয়েছিল, তাঁকে কেন উৎপাটিত হতে হল স্বভূমি থেকে? যদিও হাওয়ার্ড জিনের নাটক কার্ল মার্কসের ‘দাস ক্যাপিটাল’ লেখা নিয়েও স্বগতোক্তিতে নিজের ক্ষোভের কিছু কথা শুনিয়েছেন। নাটকের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তাঁর নিজের রচনা ও সমাজ দর্শনের প্রতি আত্মসমালোচনা। সেটা কিছুটা তৎকালীন শাসকদের প্রায়োগিক ব্যর্থতা, কিছুটা নিজের ভুল সিদ্ধান্ত। এবং রয়েছে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে এলেনার সঙ্গে বাক লড়াই, আর্থিক দুরবস্থা, এঙ্গেলসের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা এবং লেনিন তাঁর উচ্চারিত রাজনীতিকে কীভাবে অন্য পথে চালিত করেছিলেন, সেসব কথাও। এমনকী বাড়ির কাজের মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ার ঘটনাও। এই পর্বে, কৌশিক যেমন মূল নাটককে অনুসরণ করেছেন, তেমনই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে শুধু রাশিয়ার নয়, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের দুর্দশার প্রতি আঁচড়ও কেটেছেন। সংলাপ নির্ভর নাটক গতি ও গভীরতা পায় মধ্যান্তরের মুহূর্তে। যখন মঞ্চ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ফাউস্টের মেফিস্টোফেলিস, ডন অফ দি আন্ডারওয়ার্ল্ড। সঙ্গে এক রঙিন বিচিত্র ভঙ্গিতে সারা মঞ্চ ঘুরে বেড়ানো সঙ্গিনী। ভয়ঙ্কর এক পোশাকে সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁর শরীর ও বাচন ভঙ্গিতে নিয়ে আসেন একটি আয়না, মার্কসের সামনে সেই আয়নাটি বারবার ধরেন তিনি। আজকের ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া ব্যবস্থায় মার্কসের নীতি যে এতটুকু কার্যকরী নয়, হচ্ছেও না, সেটা জানিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলে মেফিস্টো। এমনকী একজন সফল স্বামী, বাবা হিসেবে মার্কসের ব্যর্থতাও আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় সে। মেফিস্টোর যুক্তির সামনে ক্ষণিকের জন্য হলেও মাথা নোয়াতে হয় মার্কসকে। তবে শেষ পর্যন্ত নাটকে শ্রমিক শ্রেণীর লড়াইয়ের আহ্বান দিয়ে নাটকের সমাপ্তি ঘটে। নাটকের শুরু হয়েছিল মঞ্চে বিরাট আকারের যন্ত্রপাতি নিয়ে কর্মরত একদল শ্রমিকের স্লোগান দিয়ে। যারা আওয়াজ তুলেছিল ‘উই শ্যাল নট বি মুভ্ড’! অর্থাৎ তাঁরা আন্দোলন ছেড়ে যাবে না। নাটকের শেষে ফিরে এলো আবার সেই বিশাল পেলোডার, মাটি খোঁড়ার যন্ত্র এবং একদল শ্রমিক। আর তাঁদের কন্ঠে সলিল চৌধুরীর সেই চিরকালীন সংগ্রামী সঙ্গীত ‘আহ্বান শোনো আহ্বান…’। পুরো মঞ্চ এবং দর্শকদের গলাতেও তখন সেই একই গান।
মার্কসের রাজনীতি একটি দর্শন, সামাজিক দর্শন, তাঁকে ব্যখ্যা করার অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ রয়েছে, আর সেখানেই লুকিয়ে থাকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুড়ঙ্গ। বুর্জোয়া ব্যবস্থা সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে মানুষের মনে ঈশ্বর, আধ্যাত্মবাদ ইত্যকার ইলিউশন তৈরি করে মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে, আর বিভেদ না থাকলে তাঁদের মুনাফা লুটতে অসুবিধে হয়। এখনতো দেখাই যাচ্ছে বেজিং এবং হোয়াইট হাউস কেমন একই লাইনের যাত্রী! নাটকে মেফিস্টো সেকথা উচ্চারণও করেছে। অনিবার্য পরিণতি কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর জাগরণে। সেটা শুধু কিউবায় হবে, নাকি দক্ষিণ আমেরিকায় বা ভিয়েতনামে কিংবা আরও অনেকানেক দেশজুড়ে, নাকি আবারও এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্নান করব আমরা, সেটা মার্কসীয় দর্শনে স্পষ্ট নয়। প্রযোজনা এবং নাটকটি উপস্থাপনার কাজে কৌশিক সেন তাঁর দক্ষ নাট্যশৈলীর পরিচয় দিলেন আবারও। তাঁর ক্ষুরধার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সুষম মিলনও সুস্পষ্ট।
উল্লেখ্য, নাটকটি ইংরেজি ভাষায় হলেও অত্যন্ত সমসাময়িক এবং একই সঙ্গে চিরন্তন এক বার্তা দিয়ে যায়। অভিনয়ে প্রধান দুটি চরিত্র কার্ল মার্কস ও মেফিস্টো হয়েছেন যথাক্রমে জয়ন্ত কৃপালানি এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায়। বৃদ্ধ মার্কসের শারীরিক জড়তা যেমন জয়ন্ত প্রকাশ করেছেন, তেমনই যুবক মেফিস্টোর সঙ্গে তর্কের সময়ে তিনি প্রয়োজনে বেশ তেজিয়ান। অন্যদিকে মেফিস্ট সাজে সৃজিতের প্রবেশ ও প্রস্থান যেমন নাটকীয়, তেমনই তাঁর অভিনয়ও বেশ জোরালো, জীবন্ত এবং এক আধুনিক ডনের মতোই ক্রুড় ও খলপনা মেশানো। মেফিস্টো আসার পরই নাটক যেন গতি পায়। স্ত্রী জেনির ভূমিকায় দিতিপ্রিয়া সরকার শান্ত মেজাজ বজায় রেখেছেন বরং তুলনায় মেয়ে এলেনোর চরিত্রে শৈলী ভট্টাচার্য অনেক বেশি জীবন্ত, প্রাণময়। শেষপাতে স্বপ্নসন্ধানীর একঝাঁক সহযোগী শিল্পী পুরো নাটকের মেজাজের সঙ্গে সুন্দর সঙ্গত করেছেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.