ইন্দ্রনীল শুক্লা: প্রাইভেট ডিটেকটিভ কি আজকাল আর খুনের কিনারা করে নাকি! ইন্টারনেটের যুগে গোয়েন্দাগিরি বদলে গেছে! এখন হলে মানিকদা ছবিটা অমুকভাবে বানাতেন। কাশ্মীরে যা অবস্থা সেখানে একখানা পিস্তল নিয়ে কাপ্তেনি করতে গেলে… এইসব কঠিন ইন্টেলেকচুয়াল যুক্তিগুলো সরিয়ে দেওয়া যাক মাথা থেকে। বরং বলা যাক ভুটিয়া সোয়েটার, কাশ্মীরি শালওয়ালা, ইডেনে টেস্ট, সার্কাস কিংবা নলেন গুড়ের মতোই এবারের শীতেও মিলেছে আরও একখানা ফেলুদার ছায়াছবি। এবং এবার ‘মিশন কাশ্মীর’।
ফেলুদার কাহিনিগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে জটিল কাহিনি ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’, তাই নিয়েই ওয়েব সিরিজ গড়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়, যা কিনা ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি ফ্রাঞ্চাইজির নবতম সংযোজন। রায়বাড়ির অনুমোদন না থাকায় আপাতত এটাই এই সিরিজের অন্তিম কাহিনি, এমনটাও জানা যাচ্ছে। বিশেষ স্ক্রিনিংয়ে সিরিজটিকে বড়পর্দায় দেখার সুযোগ এই প্রতিবেদকের মিলেছে। কিন্তু এর রিলিজ ঘটেছে হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। ছবির গল্প বলে দেওয়ার দায় আলোচকের নয়। মার্ডার মিষ্ট্রির ক্ষেত্রে তো আরও নয়। তাছাড়া বই আকারে এই কাহিনি পড়েছেনও বিরাট সংখ্যক বাঙালি। জটিল জটিল সব চরিত্রের সমাহার রয়েছে তাতে। বরং ছবির নানা দিকগুলোয় তাকানো যাক। কাহিনিটা সত্যজিৎ রায়ের মূল গল্পের অনুসরণেই রেখেছেন সৃজিত। কিন্তু সময়, ব্যাকড্রপ কিছু ক্ষেত্রে বদলেছেন। কাশ্মীর যেখানে ঘটনাস্থল সেখানে নয়নাভিরাম দৃশ্য যে থাকবে আন্দাজই করা যায়। ঘটেছেও তাই। কখনও বরফ ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ, কখনও লিডার নদীর জল, কখনও ডাল লেকের বোট কিংবা পাড়ারের মাথায় মেঘের আনাগোনা চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে। টপ শটে পাহাড়ি পথে ঘোড়া যাওয়ার দৃশ্যও বেশ মনে থেকে যায়। সেটা আপাতভাবে মনে হতে পারে যে এ কী ট্রাভেল ভিডিও নাকি যে এসব দেখাতে হবে! কিন্তু ওই যে গোড়াতেই বলেছি ইন্টেলেকচুয়াল যুক্তি সরিয়ে রাখতে। ব্যাপারটা এমনভাবেও ভাবা যেতে পারে যে এমন সৌন্দর্যের পাশেই ভয়ানক খুনের ঘটনা, আরও বেশি করে শক দিতে পারছে দর্শককে। চমক আছে প্লানচেটের দৃশ্যেও।
শাল গায়ে জড়িয়ে কিংবা কোটের সঙ্গে গলায় মাফলার জড়ানো টোটা রায় চৌধুরীকে প্রতিটি নতুন ফেলুদায় আরও শার্প লাগছে। সত্যজিতের সিনেমার ফেলুদা নয়, তাঁর সঙ্গে মারাত্মক মিল সত্যজিতের স্কেচ করা ফেলুদার। চাহনি, কথা বলা, শরীরের ফিটনেসগত ভাষায় তিনি নিজের মতো একটা ফ্যান ফলোয়িং তৈরি করতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। আর অনির্বাণ চক্রবর্তীকে তো একেনবাবু হিসেবে দেখার পর থেকেই মানুষ নিজের মতো করেই কাস্টিং করে ফেলেছেন জটায়ু হিসেবে। লালমোহন গাঙ্গুলির পোশাক তাঁর গায়ে ভালোই ফিট করেছে, যদিও সেটা সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন কাজ (প্রদোষ সি মিটারকে মাথায় রেখেই বলছি)! আর তোপসে হিসেবে কল্পনের মুখের ইনোসেন্স মানিয়ে গিয়েছে। রজতাভ দত্ত নিজস্ব ম্যানারিজম নিয়েই উতরে দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মল্লিকের চরিত্র। কিন্তু তাঁর সহকারীর ভূমিকায় ঋদ্ধি সেন কিংবা চিকিৎসকের ভূমিকায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে যেন আড়ষ্ট লেগেছে। এই দুই বড় অভিনেতার ক্ষেত্রে এমনটা কেন ঘটল সত্যিই বোধগম্য হল না।
জঙ্গি কার্যকলাপ, নির্বাচন রাজনীতি ঘিরে অশান্ত কাশ্মীর উপত্যকাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়ে এসেছেন সৃজিত। এমন ধরনের কাজ তিনি আগেও করেছেন। ‘মিশর রহস্য’তে আমরা মিশরের অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির আঁচ মূল কাহিনির বাড়তি হিসেবে পেয়েছিলাম। এটা ওঁর একটা স্টাইল। একটা আফশোসের কথা পরিশেষে। উপত্যকায় কিছু দৃশ্য চমৎকার লেগেছে বড়পর্দায় যখন দেখেছি। কিন্তু ছয় এপিসোডে তৈরি এই কাহিনি মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্ট টিভিতে দেখার সময় এমন চোখ জোড়ানো আনন্দটা মিলবে তো? সেটা অবশ্য এই ছবি কেবলমাত্র নয়, ওটিটি বনাম পর্দার বৃহত্তর বিতর্কের অঙ্গ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.