বাঙালি ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারের জীবনের শেষ আট বছর আর নায়িকাদের চোখে মহানায়কের জীবন দর্শন নিয়ে তৈরি হচ্ছে ডকু-ফিচার ‘যেতে নাহি দিব’। লিখছেন সোমনাথ লাহা।
বাঙালির ম্যাটিনি আইডল মহানায়ক উত্তমকুমার। তাই তো মৃত্যুর ৩৯ বছর পরেও তিনি রয়ে গিয়েছেন আপামর বাঙালির অস্থি-মজ্জা জুড়ে। দর্শকদের মনের মণিকোঠায় আজও তিনি সদা বিরাজমান। তিনি শুধুমাত্র মহানায়ক নন, এককথায় বাঙালির আবেগ। তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ বাংলা ছবি।
একসময়ের ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন উত্তমকুমার। নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে প্রায় এককভাবে হয়ে গিয়েছিলেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অধিপতি। আজও তাই না থেকেও তিনি ভীষণরকমভাবে রয়ে গিয়েছেন টলিউডে। আর তাঁকে কেন্দ্র করে একসময় নানা বিখ্যাত গল্পের জন্ম হয়েছে টলিপাড়ায়।
এহেন কিংবদন্তি অভিনেতার পুরো জীবনটিকেই টুকরো টুকরো কোলাজ গাথায় মোড়কবদ্ধ করে বড় পর্দায় মেলে ধরেছেন পরিচালক প্রবীর রায়। তাঁর ডকু ফিচার ‘যেতে নাহি দিব’র মধ্যে দিয়ে। বাংলা টেলিভিশনের গোড়ার দিকের বহু সফল ধারাবাহিকের নির্মাতা প্রবীর রায় একাধারে প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা। কলকাতা দূরদর্শনে শুরুর দিকে বহু সফল প্রযোজনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। এমনকী মহানায়কের মৃত্যুর পর আটের দশকে কলকাতা দূরদর্শনে তাঁর প্রযোজনায় ও পার্থপ্রতিম চৌধুরির পরিচালনায় দুই পর্বে তৈরি হয়েছিল শ্রদ্ধার্ঘ্য অনুষ্ঠান ‘যেতে নাহি দিব’। পার্থপ্রতিম চৌধুরির দেওয়া সেই নামটিই তাঁর এই ডকু ফিচারে ব্যবহার করেছেন পরিচালক। ছবির ট্যাগলাইন ‘বাণিজ্যিকতার ঘেরাটোপে এক অভিমন্যু সেদিন – আজও…’।
এখানেই শেষ নয়। মহানায়কের জীবনের শেষ আট বছর (১৯৭২-১৯৮০) তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই প্রবীণ পরিচালক। তাই তাঁর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের বহু তথ্যকেই এই ছবির মাধ্যমে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন প্রবীর রায়, যেগুলো অনেকেরই অজানা। ছবিতে সাতের দশকের এক নায়িকার চোখ দিয়েই মহানায়কের জীবনকে পর্দায় মেলে ধরেছেন পরিচালক।
ছবিতে উত্তমকুমারের চরিত্রে দেখা যাবে সুজন মুখোপাধ্যায়কে। অল্পবয়সি (যুবা বয়সের) উত্তমকুমারের চরিত্রে রয়েছেন অমিত ভট্টাচার্য। এই ছবিতে যেমন ব্যবহার করা হয়েছে উত্তমকুমার অভিনীত ‘বসু পরিবার’, ‘ইন্দ্রানী’, ‘লালপাথর’, ‘যদুবংশ’র মতো ক্লাসিক্যাল ছবির ক্লিপিংস, তেমনই উঠে এসেছে উত্তমকুমারের সমসাময়িক নায়িকাদের প্রসঙ্গও। তবে কোনও বিতর্কিত বিষয় নয়, বরং ইতিবাচক দিকটিকেই এই ছবির মধ্যে তুলে ধরেছেন পরিচালক। রয়’জ মিডিয়া অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট প্রযোজিত ও প্রেজেন্টার ফেস নিবেদিত এই ছবির কাজ হয়েছে প্রায় দু’বছর ধরে। আর্থিক প্রতিকূলতায় তৈরি হয়েছে সমস্যা। তবে তা দমাতে পারেনি পরিচালককে।
ছবিতে কাননদেবীর চরিত্রে রয়েছেন শকুন্তলা বড়ুয়া। এছাড়া রয়েছেন মল্লিকা সিনহা রায় (সুপ্রিয়া দেবী), উজ্জয়িনী বন্দ্যোপাধ্যায় (সুচিত্রা সেন), শ্রাবণী ঘোষ (মাধবী), পায়েল বন্দে্যাপাধ্যায় (সাবিত্রী), প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য (গৌরী দেবী)। ছবিতে শ্যামল মিত্রের চরিত্রে দেখা যাবে তাঁর সুযোগ্য পুত্র সৈকত মিত্রকে। ছবিতে সাতের দশকের এক অভিনেত্রীর চরিত্রে রয়েছেন ছোটপর্দায় পরিচিত অভিনেত্রী স্বস্তিকা দত্ত। ছবিতে এছাড়াও রয়েছেন দুলাল লাহিড়ী, সুদীপ সরকার প্রমুখ শিল্পীরা। ছবির বিষয় ভাবনা পরিচালকের নিজের। চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা অশোক রায়। সংগীত পরিচালনায় দীপ্তেশ-প্রদীপ্ত। প্লেব্যাকে রয়েছেন সাগ্নিক সেন ও প্রীতি বসু। সিনেমাটোগ্রাফার অরিন্দম ভট্টাচার্য।
সম্প্রতি বাইপাস সংলগ্ন একটি ক্লাবে এই ছবির নায়িকাদের লুক প্রকাশ্যে আনলেন পরিচালক। ইতিমধ্যেই মুক্তি পেয়েছে ছবির ট্রেলার ও মিউজিক। ২২ নভেম্বর মুক্তি পেতে চলেছে এই ছবি। ছবি প্রসঙ্গে পরিচালক প্রবীর রায় জানান, “উত্তমকুমারকে নিয়ে আমাদের এখানে বড়পর্দায় সেভাবে কোনও কাজ হয়নি। বহুদিন আগে স্বপন দাস একটা ডকুমেন্টারি করেছিলেন। তবে উত্তমকুমার তো শুধু অভিনেতা নন, তিনি একাধারে প্রযোজক, পরিচালক ও সংগীত পরিচালক। তাঁর প্রতিটি বিষয়কে নিয়েই একটা ছবি তৈরি করা যায়। এরকম একটা মানুষকে দু’ঘণ্টায় পর্দায় তুলে ধরা অসম্ভব। প্রথমে আমরা ডকুমেন্টারি করব বলেই স্থির করি। আমি ওনাকে যেটুকু কাছ থেকে দেখেছি সেটাই অশোককে (ছবির চিত্রনাট্যকার) বলি। তারপর দেখি সেটা এত বড় হয়েছে যে তথ্যচিত্রে হবে না। তখন পুরো জীবনটাকে নিয়ে এই ছবিতে স্বল্পভাবে মেলে ধরেছি। ঘরোয়া আড্ডায় দেখেছি কীভাবে উত্তমদার সারা শরীর কাঁপত হাসার সময়। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর তিনি পাঞ্জাবি বদল করতেন। এমনই ছিল তাঁর ফ্যাশন, ক্যারিশ্মা”।
শকুন্তলা বড়ুয়ার অভিমত “প্রবীর যখন আমায় কানন দেবীর চরিত্রটা এই ছবিতে অফার করে আমার মনে একটা সাংঘাতিক রিঅ্যাকশন হয়েছিল। আমি নিজেও ওনার ফ্যান ছিলাম। যেহেতু আমি গান গাইতাম। তারপর অভিনয়ে আসার পর মনে হয়েছিল যদি ওনার মতো নায়িকা-গায়িকা হতে পারি তাহলে লোকে আমায় কানন দেবীর মতো মনে রাখবে। কানন দেবীর হাত থেকে আমি পুরস্কারও নিয়েছি।”
উত্তমকুমার প্রসঙ্গে নস্ট্যালজিক শকুন্তলার মত, “আমি আজও ওই সময়টায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি। দাদার জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি। তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ঈশ্বরপ্রদত্ত আশীর্বাদ তাঁকে ওই জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। সেখানে পৌঁছনো আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.