Advertisement
Advertisement
Soil Health Card

চাষের আগে জানতে হবে মাটির স্বাস্থ্য! সয়েল হেল্থ কার্ডে সুরাহা কৃষকের

কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের জানানো হবে কোন ফসল চাষ করা উচিত এবং কোন সার বা সংশোধক প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে।

Soil Health Card is the ultimate solution for farmers

ফাইল ছবি

Published by: Paramita Paul
  • Posted:November 13, 2024 2:31 pm
  • Updated:November 13, 2024 2:31 pm  

মাটি স্বাস্থ্য কার্ড প্রকল্পটি কৃষিক্ষেত্রের একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। সঠিক পুষ্টি ব্যবস্থাপনা মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখে, ফলে ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এই স্কিমের মাধ্যমে দেশের কৃষকরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতেও সাহায্য করবে। তাই, সঠিকভাবে মাটির পরীক্ষা করিয়ে মাটি স্বাস্থ্য কার্ড ব্যবহার করা চাষিদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। লিখেছেন নয়াদিল্লির আইসিএআর-আইএআরআই এর মৃত্তিকা বিজ্ঞান ও কৃষি রসায়ন বিভাগের গবেষক ড. খুরশিদ আলম ও দক্ষিণ দিনাজপুর কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (মৃত্তিকা বিজ্ঞান) ড. বাপ্পা পরামানিক

যেমন আমরা নিয়মিতভাবে আমাদের শরীরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি, তেমনই আমাদের ক্ষেতের মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটির সঠিক পুষ্টি উপাদান ছাড়া ফসল ভালোভাবে বাড়তে পারে না। কৃষিকাজের জন্য জমির মাটি কতটা উর্বর এবং কোন কোন পুষ্টি উপাদানের অভাব রয়েছে তা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে, ভারত সরকার ‘সয়েল হেল্থ কার্ড’ বা ‘মাটি স্বাস্থ্য কার্ড’ প্রকল্প চালু করেছে ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ তারিখে। এই স্কিমের মাধ্যমে চাষিরা তাঁদের জমির মাটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ একটি ‘সয়েল হেল্থ কার্ড’ বা ‘মাটি স্বাস্থ্য কার্ড’ পাবেন, যেখানে মাটির কোন পুষ্টি উপাদানগুলো প্রয়োজন তা জানানো থাকবে এবং কীভাবে সঠিক পরিমাণে সেগুলো জমিতে প্রয়োগ করা যায় সেই পরামর্শও থাকবে। এই কার্ডের সাহায্যে চাষিরা মাটির সঠিক যত্ন নিতে পারবেন এবং সঠিক সার প্রয়োগ করে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে পারবেন। সরকারের লক্ষ্য হল দেশের ১৪ কোটি কৃষককে এই মাটি স্বাস্থ্য কার্ড সরবরাহ করা, যাতে তাঁরা তাঁদের জমিতে কী কী পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন তা বুঝতে পারেন এবং জমির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারেন।

Advertisement

‘সয়েল হেল্‌থ কার্ড’ কী?
মাটি স্বাস্থ্য কার্ড হল একটি ছাপানো বিস্তারিত রিপোর্ট, যা একজন কৃষক তার জমির জন্য পায়। এটি জমির পুষ্টি উপাদানের পরীক্ষা করা ডেটার ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়। এই কার্ডে জমির ১২টি প্রধান পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে তথ্য থাকে। মাটির উর্বরতা এবং ফসলের ভালো ফলনের জন্য এই পুষ্টিগুলি গুরুত্বপূর্ণ। এই ১২টি পুষ্টি উপাদান হল:

(১) প্রধান পুষ্টি উপাদান
নাইট্রোজেন (N), ফসফরাস (P), পটাশিয়াম (K) এগুলি মাটির প্রধান পুষ্টি উপাদান, যা ফসলের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।

(২) গৌণ পুষ্টি উপাদান
সালফার (S)

(৩) অণুখাদ্য
দস্তা (Zn), লোহা (Fe), তামা (Cu), ম্যাঙ্গানিজ (Mn), এবং বোরন (B)

(৪) মাটির শারীরিক বৈশিষ্ট্য
পিএইচ (pH), ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি (EC) এবং জৈব কার্বন (Organic C)। মাটির এই বৈশিষ্ট্যগুলি ফসলের শিকড়ের পুষ্টি গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে। এই কার্ডটি চাষিদের প্রতি তিন বছর অন্তর দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা মাটির পরীক্ষা অনুযায়ী সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে পারেন এবং মাটির স্বাস্থ্যকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে রক্ষা করতে পারেন।

মাটি নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়া

জমি বাছাই ও নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ সমতল জমির ক্ষেত্রে প্রতি তিন থেকে চার একরের জন্য একটি নমুনা সংগ্রহ যথেষ্ট। তবে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, সেচকৃত জমির ক্ষেত্রে প্রতি ২.৫ হেক্টর এবং বৃষ্টিনির্ভর জমির ক্ষেত্রে প্রতি ১০ হেক্টর থেকে মাটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা নেওয়ার জন্য জমির এক একরে ১০-১২টি এলোমেলো স্থান বাছাই করতে হবে।

গর্ত খনন
প্রতিটি স্থান থেকে খুরপি বা কোদাল ব্যবহার করে ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতির ৬ ইঞ্চি (ধান বা গমের মতো ফসলের জন্য) বা ৯ ইঞ্চি (আখ, পাট, আলু প্রভৃতি ফসলের জন্য) গভীর গর্ত করতে হবে। প্রশিক্ষিত কর্মীরা জমির চার কোণ এবং কেন্দ্র থেকে নমুনা গ্রহণ করবেন, যাতে নমুনাগুলো যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করে।

মাটি চেঁছে নেওয়া
গর্তের একপাশের দেওয়াল থেকে সমানভাবে ২ ইঞ্চি পুরু মাটি চেঁছে নিয়ে একটি পরিষ্কার পাত্রে রাখতে হবে। এভাবে একাধিক স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করতে হবে। জমির বিভিন্ন স্থান থেকে নেওয়া মাটি ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে।

মাটি শুকানো ও গুঁড়ানো
যদি মাটি ভেজা থাকে, সেটিকে শুকিয়ে গুঁড়িয়ে নিতে হবে। তবে, মাটি ভাঙার সময় কাঠের ডান্ডা ব্যবহার করতে হবে যাতে মাটির গুণগত মান অক্ষুণ্ণ থাকে। এরপর, মাটি সমান চার ভাগে ভাগ করে দুটি ভাগ ফেলে বাকি দুটি অংশ মিশিয়ে পুনরায় চার ভাগ করতে হবে। এভাবে ৫০০ গ্রাম মতো মাটি সংগ্রহ করতে হবে।

নমুনা কোডিং ও প্যাকেজিং
সমস্ত মাটি পলিথিনে ভরে নমুনাকে কোডিং করতে হবে, অর্থাৎ প্রতিটি নমুনাকে একটি নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে লেবেল করতে হবে। নমুনার সঙ্গে কৃষকের নাম, ঠিকানা, জমির বিবরণ, মৌজার নাম, দাগ নম্বর এবং কী ফসল চাষ হয় ইত্যাদি তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে একটি আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। প্যাকেটটি স্থানীয় কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে বা মাটি পরীক্ষাগারে পাঠাতে হবে।

GPS এবং ভূমি মানচিত্র ব্যবহার
আধুনিক প্রক্রিয়ায় জিপিএস এবং ভূমি মানচিত্র ব্যবহার করে সঠিক স্থান নির্ধারণ করে মাটি সংগ্রহ করা হয়, যা নমুনা সংগ্রহে সঠিকতা নিশ্চিত করে। এতে মাটির পুষ্টি সম্পর্কিত তথ্য আরও নির্ভুলভাবে প্রাপ্ত হয়। রাজ্য কৃষি বিভাগের কর্মী বা আউটসোর্স করা সংস্থার কর্মীরা বা স্থানীয় কৃষি ও বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।

মাটি পরীক্ষা ও সয়েল হেল্থ কার্ড
জমা দেওয়া নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হলে, সেখানে মাটির বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। মাটি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষকরা তাদের জমিতে সঠিকভাবে সার এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োগের পরামর্শ পাবেন। এই পুরো প্রক্রিয়ার শেষে কৃষকরা ‘মাটি স্বাস্থ্য কার্ড’ সংগ্রহ করতে পারবেন, যা জমির সার্বিক পুষ্টি অবস্থার একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রদান করবে।মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে কৃষকরা সহজেই তাদের জমির পুষ্টির ঘাটতি বুঝতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন, যা ফসলের উৎপাদনশীলতা এবং মাটির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

‘সয়েল হেল্‌থ কার্ড’ প্রকল্পর মাধ্যমে চাষিরা কি সুবিধা পেতে পারেন?

১) মাটির স্বাস্থ্য রিপোর্ট
এই প্রকল্পর মাধ্যমে চাষিরা তাঁদের মাটির স্বাস্থ্যের একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাবেন, যা থেকে তাঁরা জানতে পারবেন কোন পুষ্টি উপাদানগুলো মাটিতে কম আছে এবং কীভাবে মাটির গুণগত মান উন্নত করা যায়। অনেক সময় কৃষকরা সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন, যার ফলে মাটির স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে মাটি কার্ডের সাহায্যে তাঁরা জানতে পারবেন সঠিক পরিমাণে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সার ব্যবহার করতে হবে।

২) বৈজ্ঞানিক পরামর্শ
কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের জানানো হবে কোন ফসল চাষ করা উচিত এবং কোন সার বা সংশোধক প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে। উদাহরণস্বরূপ: জমির মাটিতে যদি নাইট্রোজেনের অভাব থাকে, তবে সেখানে বেশি নাইট্রোজেনযুক্ত সার প্রয়োগের প্রয়োজন হবে। যদি দস্তার অভাব থাকে, তবে সেই অনুযায়ী মাটিতে দস্তা সমৃদ্ধ সার প্রয়োগ করতে হবে।

৩) ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি
এই কার্ডের মাধ্যমে চাষিরা মাটির পুষ্টি অনুসারে সঠিক পরিমাণ সার এবং মাটি সংশোধক প্রয়োগ করতে পারবেন। এতে করে রাসায়নিক সারের অপচয় কমে এবং খরচও অনেক কম হয়। এছাড়া মাটির পুষ্টি ও সার ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সয়েল হেল্থ কার্ডের পরামর্শ মেনে সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে ফসলের উৎপাদনশীলতা ৫-৬% বাড়বে এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার ৮-১০% কমবে (ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি কাউন্সিল এর রিপোর্ট অনুযায়ী)

৪) মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা
নিয়মিত মাটির পরীক্ষা করে চাষিরা প্রতি তিন বছর অন্তর মাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপডেট পাবেন। এটি মাটির পুষ্টি বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং ফসল উৎপাদনে স্থায়ীভাবে সুফল দেবে।

৫) কর্মসংস্থান সৃষ্টি
এই স্কিমের অধীনে গ্রামের যুবক ও কৃষকরা মাটি পরীক্ষা করে মাটি স্বাস্থ্য ল্যাব স্থাপন করতে পারবেন, যা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, কৃষি সমবায় সমিতি, কৃষক গোষ্ঠী এবং কৃষি উৎপাদক সংগঠনগুলো এই সুযোগটি পেতে পারেন।

আরও কিছু টিপস
জৈব সার ব্যবহারের গুরুত্ব
রাসায়নিক সার ব্যবহারের পাশাপাশি জৈব সারও ব্যবহার করলে মাটির স্বাস্থ্য দীর্ঘমেয়াদে ভালো থাকে। কম্পোস্ট, সবুজ সার, গোবর সার ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।ফসল চক্র পরিবর্তন:একই ফসল বারবার চাষ করার পরিবর্তে ফসল চক্র পরিবর্তন করলে মাটির পুষ্টি ঘাটতি কম হয় এবং জমি উর্বর থাকে। যেমন, একবার ধান চাষের পর ডাল শস্য চাষ করা যেতে পারে।
(তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল পোর্টাল অফ ইন্ডিয়া ও ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement