Advertisement
Advertisement
Jharkhand

ভূতের রাজার অভিশাপ, মহাশক্তির যূপকাষ্ঠে আজও রক্ত দিচ্ছে জাদুগোড়া

জঙ্গল ঘেরা ওই অভিশপ্ত অশ্বত্থতলার ধার মাড়াতো না কেউই।

Side effects of uranium plant in Jharkhand Jadugoda
Published by: Amit Kumar Das
  • Posted:May 23, 2025 6:12 pm
  • Updated:May 23, 2025 11:37 pm  

অমিত কুমার দাস: অন্ধকার আর আলো যেমন একে অপরের পরিপূরক, ঠিক তেমনি আশীর্বাদ ও অভিশাপ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে গা ঘেঁষে। অমৃত ভান্ডের ঠিক নিচে লুকিয়ে আছে কালকূট, অমরত্ব স্বাদ নিলে সে বিষের জ্বালাও সহ্য করতে হবে কাউকে না কাউকে। এই নির্মম সত্য জাদুগোড়ার চেয়ে ভালো বোধহয় কেউ জানে না। দেশকে মহাশক্তির দৈব আংটি পরিয়ে সেই প্রাণঘাতী গরল আজও গলাধঃকরণ করছে ঝাড়খণ্ডের ছোট্ট এই জনপদ।

Advertisement

এককালে আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের সঙ্গে কোনও পার্থক্য ছিল না এই গ্রামের। পাহাড় জঙ্গল গায়ে মেখে শিকার, উৎসব নিয়ে দিব্যি দিন কাটত এখানকার মানুষের। সমস্যা অবশ্য একটা ছিলই, তা হল গ্ৰামের এক বুড়ো অশ্বত্থ গাছ। লোকে বলত ওখানে ভূত আছে। ওই যে গাছের পাশে যে ফাঁকা জায়গা, ওখানে গেলে আর রক্ষে নেই। গ্রামের অশিক্ষিত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মনে এই ধারণা তৈরি হওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণও ছিল। যেমন কোনও গর্ভবতী মহিলা গাছের নিচ দিয়ে গেলে তার সন্তান নষ্ট হওয়া, ছোট শিশু বা বয়স্করা পড়ত অসুখে। রেহাই ছিল না পুরুষদেরও। ফলে জঙ্গল ঘেরা ওই অভিশপ্ত অশ্বত্থতলার ধার মাড়াতো না কেউই।

সালটা ১৯৫০। মুখে মুখে ফেরা জাদুগোড়ার ভূতের গল্প একদিন পৌঁছল সরকার বাহাদুরের কানে। রহস্যের গন্ধ পেয়ে গ্রামে পাঠানো হলো তদন্তকারী দল। ধীরে ধীরে সরলো অন্ধকারের কালো পর্দা। ১৯৫১ সালে ভূত নামের মিথের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক মহাশক্তির খোঁজ পেল ভারত। যার নাম ইউরেনিয়াম। এক মহামূল্যবান ধাতু। পরমাণু বোমাতো বটেই বিজ্ঞানের নানা অলিগলিতে এর অপার চাহিদা। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারত জাদুগোড়াকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করল ‘স্বাবলম্বী’ হওয়ার। উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। শুরু হয়ে গেল তৎপরতা। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ১৯৬৭ সালে ইউসিআইএল গঠন করে শুরু হল ইউরেনিয়ামের খননকার্য। একই সঙ্গে শুরু হলো জাদুগোড়ার সর্বনাশ। অশ্বত্থতলায় বন্দি অভিশাপের হাঁড়ির ঢাকনা খুলে গেল মুহূর্তে। শিকলমুক্ত ভূতের রাজা রক্ত শুষতে শুরু করল গোটা গ্ৰামের।

১ কেজি ইউরেনিয়ামের অর্থ ১৭৫০ কেজি বর্জ্য। এই ইউরেনিয়াম তুলে নেওয়ার পর তা পাঠানো হত হায়দরাবাদে। আর এই বিরাট পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বর্জ্য জমা হত জাদুগোড়ায়। অর্থাৎ এই অঞ্চল পরিণত হল এক পারমাণবিক বর্জ্যের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। যার ফল হল মারাত্মক। ইউরেনিয়ামের সঙ্গে সেখানে আছে রেডিয়াম, থোরিয়ামের মতো বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় ‘ডটার’ নিউক্লেইড, আছে বিক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত গামা রশ্মি ও রেডন গ্যাস। যা শরীরে গেলে ধাপে ধাপে মানুষকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। একাধিক রিপোর্ট বলছে, এই গ্রামের বাতাসে মিশে রয়েছে ১ মিলিবিট রেডন গ্যাস। ডাম্পিং গ্রাউন্ড ও ইউরেনিয়াম পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত টেলিং পন্ডে এর পরিমাণ দশের বেশি। যা রীতিমতো বিপজ্জনক। ফলে বছরের পর বছর ধরে রেডন নামের বিষ শুষতে থাকেন এখানকার মানুষ। পরিণতি, মহিলাদের সন্তান নষ্ট, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, ক্যানসার, টিবি, ঘরে ঘরে বাড়তে থাকে অসুখ। গ্রামবাসীরাও জানতেন না কেন ঘটছে এই ধরনের ঘটনা।

৯০ দশকে সামনে চলে আসে জাদুগোড়ার ভয়ংকর পরিণতির কথা। ১৯৯০ সালে এক সমীক্ষার রিপোর্টে জানা যায়, এই অঞ্চলের ২৫ শতাংশ শিশু কোনও না কোনও শারীরিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্ম নেয়। ৬৭ শতাংশ মানুষ মারা যান ৬০ বছর বা তারও আগে। এখানেই শেষ নয়, টেলিং পন্ডের তেজস্ক্রিয় জল বৃষ্টিতে উপছে, পাইপ ফেটে বা লিকেজের জেরে মাঝেমধ্যেই মেশে স্থানীয় নদী ও পুকুরে। ফলে বাতাস তো বটেই সরাসরি এই তেজস্ক্রিয় মৌলের সংস্পর্শে আসেন এলাকাবাসী। ফলে মৃত সন্তান প্রসব বা বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দেওয়া হয়ে ওঠে সাধারণ ঘটনা। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে সুস্থ শরীরে জন্ম নিলেও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিকলাঙ্গ হয়েছে শিশুটি। বর্তমানে এখানে চারজন শিশুর মধ্যে একজন বিকলাঙ্গ রূপে জন্ম নেয়।

যদিও দেশের সরকার এ বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে রাজি নয়। বরং জাদুগোড়াকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখতেই বেশি তৎপর প্রশাসন। রেডন গ্যাসের তথ্য অস্বীকার না করলেও ইউসিআইএল-এর দাবি, গ্রামবাসীদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই এই সমস্যার জন্য দায়ী। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, এই গ্রাম বসবাসের অযোগ্য। তীব্র রেডিয়েশনের প্রভাবে মাটি, জল এবং বাতাস সবেতে মিশেছে বিষ। গোটা গ্রাম চাষের অযোগ্য হয়েছে বহু আগেই, বিষের কোপে কে যাচ্ছে ওই অঞ্চলের গাছপালা। তবুও নির্মম মৃত্যু জেনেও ভিটে মাটি আঁকড়ে এখানে পড়ে রয়েছেন দরিদ্র আদিবাসী পরিবারগুলি। সাধারণত, কোনও অঞ্চলে এই ধরনের বহুমূল্য সম্পদের সন্ধান পেলে তার হাল ফিরে যায় রাতারাতি। বিপুল আর্থিক উন্নতি ঘটে এলাকাবাসীর। তবে এখানে গল্পটা ভিন্ন, বহুমূল্য সম্পদের বিনিময়ে ন্যূনতম লভ্যাংশ তো দূর, বরং দেশকে মহাশক্তির দৈব আংটি পরানোর মাশুল নিজের জীবন দিয়ে গুনছে ঝাড়খণ্ডের ছোট্ট গ্রাম জাদুগোড়া।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement