কিশোর ঘোষ: ‘যুদ্ধ হল পশুত্বের জয়, মনুষ্যত্বের পরাজয়।’ ১৯১৭ সালে ‘জাতীয়তাবাদ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাকিস্তান সেকথা বার বার প্রমাণ করেছে। ফলে বিএসএফ জওয়ান পূর্ণম সাউ কিংবা উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের মতো সৌভাগ্য হয়নি সকলের। ওঁরা নৃশংস পাক বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও জীবিত অবস্থায়, এমনকী সুস্থ শরীরে দেশে ফিরেছেন। অন্যদিকে একাধিক ভারতীয় জওয়ানের দেহ ফিরে এসেছে নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন নিয়ে। কার্গিল যুদ্ধের সময় পাক সেনার নির্মম নির্যাতনের শিকার হন স্কোয়াড্রন লিডার অজয় আহুজা। তবে বর্বরতার সমস্ত সীমা ছাপিয়ে গিয়েছিল ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার ক্ষেত্রে। পূর্ণম ফিরে আসায় যুদ্ধবন্দিদের সেই রক্তাক্ত ইতিহাস মনে পড়ছে দেশবাসীর।
স্কোয়াড্রন লিডার অজয় আহুজা
চরম নির্যাতন করা হয়েছিল স্কোয়াড্রন লিডার অজয় আহুজার ক্ষেত্রে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কার্গিল যুদ্ধের সময় মিগ-২১ যুদ্ধবিমান নিয়ে একটি নিখোঁজ মিগ-২৭-কে খুঁজতে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৭ মে পাকিস্তানের একটি ‘সারফেস টু এয়ার মিসাইল’ তাঁর মিগ ২১-কে আঘাত করে। অজয়কে বন্দি অবস্থায় হত্যা করেছিল পাকবাহিনী। তিনি ইজেক্ট করে নামতে পারলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভারতীয় সেনার অভিযোগ, বন্দি অবস্থায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল অজয়কে। পরে সেই দেহ ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া
২২ বছরের কালিয়া। কার্গিল হাইটসে ৪ জাঠ রেজিমেন্টে দায়িত্বে ছিলেন। কাকসার এলাকায় পাঁচ জন সেনার সঙ্গে নজরদারি চালাচ্ছিলেন। নিয়ন্ত্রণরেখার এপারেই ছিলেন, সেখানে অনুপ্রবেশকারীরা তাঁদের উপর হামলা চালায়। একটানা গুলির লড়াইয়ের মাঝে বুলেট ফুরিয়ে যায় কালিয়াদের। সাহায্য চেয়ে খবর পাঠালেও দেরি হয়। ততক্ষণে ঘিরে ফেলে পাক সেনা। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন কালিয়া এবং তাঁর পাঁচ সঙ্গী। ২২ দিন আটকে রেখে জেনেভা কনভেনশনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কালিয়ার উপর চলে পৈশাচিক অত্যাচার। সারা গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা, দুই কানের পর্দা ফুটো করে দেওয়া, চোখ গেলে দেওয়া, দাঁত ভেঙে দেওয়া, মাথার খুলি ফাটিয়ে দেওয়া, ঠোঁট ও চোখের পাতা কেটে নেওয়া, হাত ও পায়ের আঙুল কেটে নেওয়া, এমনকী কেটে নেওয়া হয়েছিলো যৌনাঙ্গও। সব শেষে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল সৌরভ কালিয়া ও তাঁর সঙ্গী পাঁচ জওয়ানকে। পাকিস্তান সেনা ১৯৯৯ সালের ৯ জুন কালিয়ার ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ ভারতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা, গণধর্ষণ হোক কিংবা জেনেভা কনভেনশনকে উড়িয়ে যুদ্ধবন্দি ভারতীয় জওয়ানদের অকথ্য অত্যাচার, হত্যা… এই বর্বরতা আসলে পাক সেনার চরিত্রে রয়েছে! অতএব, অভিনন্দন বর্তমান এবং পূর্ণম সাউয়ের ঘরে ফেরা যতখানি সৌভগ্যের, ততটাই নরেন্দ্র মোদি সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যও বলা যায়। তথাপি যুদ্ধবন্দিদের উপর নৃশংস অত্যাচারের বোধ হয় শেষ নেই। সেই হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ—“যেখানে বন্দুক কথা বলে, সেখানে মানবতা নির্বাক হয়ে যায়।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.