আজ কল্পতরু দিবস। চৈতন্য হওয়ার দিন। এই বাণী আমাদের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পাঠ দেয়। পরম পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সেই অমোঘ বাণী নিয়ে কলম ধরলেন বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিররে অধ্যক্ষ স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দ।
[ইসলাম গ্রহণ করেও কেন সাধনা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ?]
১ জানুয়ারি, ১৮৮৬। শ্রীরামকৃষ্ণের সমস্ত অাচরণের ও বক্তব্যের সারাৎসার ছিল তাঁর একটি কথা-‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। যার মধ্যে চৈতন্য যত বেশি প্রকাশিত হবে, তার মধ্যে এই সৎ, সুন্দর গুণগুলি তত বেশি উন্মোচিত হবে। যার মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে না, বুঝতে হবে সেখানে এই চৈতন্য অপ্রকাশিত রয়েছে। কিন্তু প্রকাশ ও অপ্রকাশ এই দু’টিতেই রয়েছে তাৎপর্য। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত অালো। অালোটা রয়েছে। অন্ধকারের অাড়ালে রয়েছে। সেই অাড়াল থেকে অালোটা বের করে অানতে হবে। সেটাই জীবনের সাধনা। প্রত্যেকটা মানুষের ভিতরে থাকা চৈতন্যর সাধনার পথে স্বাভাবিকভাবেই কিছু নির্দেশিকা দরকার। দরকার একটি দিশা থাকা। যখনই পয়লা জানুয়ারি দিনটি অাসে, সমগ্র পৃথিবী এটিকে ইংরেজি নববর্ষ রূপে বরণ করে। সেই দিনটিই অামাদের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবপ্রবাহে অাসে একটি অন্যতর তাৎপর্য নিয়ে।
[কী রহস্য কালী মূর্তিতে? কেন মা নগ্নিকা?]
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন যে, মানুষকে দেখেছেন দু’টি ধর্মবিশিষ্টরূপে – এক) মান। দুই) হুঁশ। যে নিজের এই মান-চৈতন্য সম্পর্কে সচেতন, সেই-ই কিন্তু ‘প্রকৃত’ মানুষ। মানুষ তো শুধু জৈববৃত্তিসম্পন্ন হয়ে বাঁচতে পারে না। গণমাধ্যমের দুর্ঘটনাগুলি যখন দেখি, আঁতকে উঠি নিজের ঘরের মধ্যে, ভাবি কেন এমন হচ্ছে, তখন অাসলে অামাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ওই চৈতন্যটি অামাদের অাঘাত করে। বলতে চায়, রুখে দাঁড়ানো উচিত। নেতি-র পথে যাওয়া সংসারের বিপক্ষে মানুষ দাঁড়াতে চায় বলেই সে প্রতিবাদ করে। এই প্রতিবাদের মূলে আছে তার ভিতরে থাকা ধর্ম। ‘কল্পতরু’ পুরাণের শব্দ। স্বামী সারদানন্দজি মহারাজ ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এ ‘কল্পতরু’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি বলেছিলেন, কল্পতরুর কাছে যা চাওয়া যায়, সে তাই-ই দেয়। অন্তত পুরাণে এমনই গল্প প্রচলিত অাছে। তাহলে হতেই পারে, কল্পতরুর কাছে খারাপ কিছু চাইলে কল্পতরু তাই-ই দিয়ে দিল। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে এমনটি ঘটেনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন, জগতের মানুষের যাবতীয় কল্যাণের মহৌষধি সঙ্গে নিয়ে। সেই কারণেই তিনি সেইরকম কল্পতরু, যিনি কেবলমাত্র সংসারের কল্যাণের জন্যই তাঁর অমোঘ অাশীর্বচনটি উচ্চারণ করেছিলেন। এই আশীর্বাণীটি আয়নার মতো মনে হয় আমার। আমাদের সামনেই থাকবে এবং সেটা দেখে বিচার করে নেওয়ার চেষ্টা চলবে যে, অামার ভিতরের এই চৈতন্য বিকশিত হচ্ছে কি না। সেই চৈতন্যের বিকাশেই অামাদের জীবনে ও সমাজে শিবত্ব ও সৌন্দর্য অাসবে। কল্পতরু দিবসকে তাই সারদানন্দজি মহারাজ বলেছিলেন ‘অাত্মপ্রকাশে অভয়দান’-এর দিন। পয়লা জানুয়ারি, শ্রীরামকৃষ্ণ ওই অাশীর্বচনটি উচ্চারণ করে এই বিশ্বাসটিকেই মানুষের জীবনে, অামাদের সংসারের জন্য ফিরিয়ে দিয়েছেন।
[যে রূপে বাংলায় পূজিতা কালী তা কার ভাবনায় তৈরি জানেন?]
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনীকার রিচার্ড শিফম্যান বলেছিলেন, অামরা এক অন্ধকারের যুগে এসে দাঁড়িয়েছি, যে যুগে শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছেন মানুষকে অন্ধকার থেকে অালোর পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অালোর দিকে তীর্থযাত্রায় শ্রীরামকৃষ্ণ যেন তাঁর অাশীর্বাদী হাত দিয়ে ডাকছেন। অামরা যেন সেই অালোর পথে তীর্থযাত্রা করতে পারি। সেই তীর্থযাত্রার লক্ষ্য হবে অন্তঃচৈতন্যের জাগরণ ঘটানো। যে জাগৃতিতে অামাদের ব্যক্তিজীবন থেকে সমষ্টিজীবন – যে কোনও ক্লান্তি, যে কোনও বিপর্যয়ের মুখোমুখি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। যে কোনও বিরুদ্ধতার, যে কোনও দুর্যোগের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে। এই অভয়ই শ্রীরামকৃষ্ণ দিয়েছিলেন সংসারকে। তাই ‘কল্পতরু দিবস’ অামাদের সমাজে পথ দেখানোর, দিশা দেখানোর অব্যর্থ অার্শীবাদরূপে গৃহীত হতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.