সুব্রত বিশ্বাস: ‘চলো কিছু করে দেখাই।’ চমকদার কিছু করে দেখানোর লক্ষ্য ছিল দুই বন্ধুর। বরাবরের সেই নেশাতে এবারও ইউটিউবে এমন এক ডকুমেন্টারি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন শৈশব দলুই ও সুনীল তাঁতি। হতাশ জীবন থেকে মুক্তি পেতে আত্মহননের পথ বেছে নেন অনেকেই। এই মানসিকতাকে বিরাশি শিক্কার চড় কষাতে স্বল্প দৈর্ঘ্যের এক চিত্র তৈরি করতে গিয়ে লাইনে কাটা পড়লেন ওঁরা দু’জন। ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে গিয়ে আহত হন আর এক বন্ধু। ট্রেন চলাচলের লাইনে শুটিং করার অনুমতি ভারতীয় রেলের আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এজন্য ওই তিন ছাত্র কোনওরকম অনুমতি ছাড়াই লাইনে দাঁড়িয়ে শুটিং করছিলেন। আইন অমান্য করে লাইনে ওঠায় ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয় তাঁদের। এই আইনবিরুদ্ধ কাজের জন্য অবশ্য রেল কোনও পদক্ষেপ করছে না। শিয়ালদহের ডিআরএম বাসুদেব পান্ডার কথায়, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন না ওঁরা। লাইনে উঠে শুটিং করছিলেন। তাই ট্রেনে কাটা পড়েছেন। উদাসীনতার জন্য এমন বহু মানুষ ট্রেন কাটা পড়ে। রেল পুলিশ অস্বাভাবিক মৃতু্যর যেমন কেস করে, এক্ষেত্রে তেমনটাই করবে পুলিশ। রেল বাড়তি পদক্ষেপ করবে না। শিয়ালদহ রেল পুলিশের সুপার অশেষ বিশ্বাস বলেন, রেল অভিযোগ না করায় কোনওরকম কেস দায়ের হয়নি।
সোমবার দুপুরে বাড়িতে না জানিয়েই তিনজনে লাইনে শুটিং করতে চলে যান। চলন্ত ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও শুট করার সময় ট্রেনকে গ্রাহ্য করেননি। হর্ন দিয়েও তাঁদের সতর্ক করতে পারেননি বজবজ-নৈহাটি লোকালের চালক। ফলে ট্রেনে কাটা পড়েন দু’জনেই। আরও একজন আহত হন। বাংলা ছবির পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী দুই অভিনেতাকে অপরিপক্ক মানসিকতার বলে মনে করেছেন। তাঁর পরিচালিত ‘সাথী’, ‘সঙ্গী’ ও অন্যান্য বহু ছবি রেল চত্বরে শুটিং করেন তিনি। তাঁর কথায়, যে লাইনে ট্রেন চলে সেই লাইনে শুটিংয়ের অনুমতি দেয় না রেল। চিত্রনাট্যে তেমন দৃশ্য থাকলে তিন মাস আগে আবেদন করতে হয়। প্রচুর টাকা রেলের ঘরে ডিপোজিট রেখে লাইনের পাশে আলাদা লাইন পাততে হয়। রেল প্রশাসন আশপাশের অন্তত দশটি স্টেশনের মাস্টারদের শুটিংয়ের বিষয়টি জানিয়ে রাখে। পাশ দিয়ে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনের চালক ও গার্ডের জানা থাকে শুটিং চলছে। পুলিশ ও আরপিএফ জানবে বিষয়টি, এমনকী তাঁদের অনেকই উপস্থিত থাকবেন সেখানে। রেল চত্বরে শুটিং করতে রেলকে দিতে হয় মোটা টাকা। এত হাঙ্গামা এড়িয়ে বেআইনিভাবে শুটিং করাটা বিপজ্জনক তো বটেই, জানিয়েছেন হরনাথ।
বেঁচে যাওয়া বন্ধু শৌনদীপ সাঁতরার কথায়, শুটিংয়ে বিভোর থাকায় ট্রেন আসার বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। সুনীলের মতো ছেলে যে ওভাবে লাইনে গিয়ে শুটিং করতে পারেন একথা বিশ্বাসই করতে পারছে না পরিবার। তাঁর দিদির কথায়, শ্বশুরবাড়ির দরজায় তাঁকে পৌঁছে দিয়ে নিজে সেই বাড়িতে ঢুকতে লজ্জা পায়, সেই ভাই কী করে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠল তা বুঝতে পারছেন না। স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করার। সেনাবাহিনীতে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিলেও বাড়ির আপত্তি পরীক্ষায় বসা হয়নি। শৈশবও হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা শান্তি দলুই বলেন, ছবি তৈরিতে আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু কলেজের প্রজেক্ট বলায় আর বাধা দিইনি। তাঁকে ঘিরেই স্বপ্নের সৌধ গড়ছিল পরিবার। দুই ছাত্রের মৃত্যুতে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল দুই পরিবারের। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুই বন্ধুর নিথর দেহ পানিহাটি এলাকার পাটবাড়ি লেনে যেতেই কান্নার রোল উঠল। বাতাসে হাল্কা ঠান্ডার রেশও ভারী হয়ে উঠল কিছু সময়ের জন্য।
ছবি- শুভাশিস রায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.