Advertisement
Advertisement
Nalanda University

তিন মাস ধরে দাউদাউ জ্বলেছিল নালন্দার পাঠাগার, কেন এই মহাবিহার ধ্বংস করেছিলেন খিলজি?

ভিন দেশের মেধাবী ছাত্রদেরও শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।

Why Nalanda University destroyed, Know the history
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 1, 2025 7:37 pm
  • Updated:June 1, 2025 7:37 pm  

বিশ্বদীপ দে: দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। অতিকায় পাঠাগারের ভিতরে লেলিহান শিখারা গিলে খাচ্ছে বইগুলিকে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বই। এই খিদে যেন অনন্ত। একের পর এক বই মিলিয়ে যাচ্ছে আগুনের গনগনে জঠরে, তবুও সেই আগুন নিভছে না। শেষ পর্যন্ত ৩ মাস পরে নিভল সেই আগুন। পুড়ে ছাই হল পাঠাগারের সমস্ত বই। আজও এই দৃশ্যের কথা ভাবলে শিউরে ওঠে দুনিয়া। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভূ-ভারতে ছিল না। প্রায় ৮০০ বছর ধরে কেবল ভারত নয়, ভিন দেশের মেধাবী ছাত্রদেরও শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জ্ঞানের এই মহৎ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন তুর্কি যোদ্ধা মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। কেন? কেন এভাবে ধ্বংস হতে হয়েছিল নালন্দাকে?

Advertisement

সেকথায় আসার আগে একবার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবকে ছুঁয়ে দেখা দরকার। ‘নালন্দা’ শব্দটির অর্থ জ্ঞানের অনন্ত প্রবাহ। এমন সার্থক নামকরণ সত্যিই অভাবনীয়। যদি কোনও দিন টাইম মেশিন আবিষ্কার হয়, তাহলে একবার ঘুরে আসা যেত। কিন্তু তা যখন নেই, মনে মনে ইতিহাসের পাতাকে স্পর্শ করে ঘুরেই আসা যায়। এক জমজমাট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যাকে বলা হত মহাবিহার। পড়ুয়া-শিক্ষকে গমগম করছে সর্বত্র। ওই বেজে উঠেছে কাড়া নাকাড়া। দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে আসছেন এক চৈনিক ছাত্র। নাম তাঁর হিউয়েন সাং! তাঁর এবং ইটসিংয়ের মতো চৈনিক পরিব্রাজকের লেখায় সেই কবেকার হারানো এক কালখণ্ডকে ফুটে উঠতে দেখেছি আমরা।

Nalanda University

আজ ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে। হাজার দশেক ছাত্র। দেড় হাজার (মতান্তরে ২ হাজার) শিক্ষক। চিন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কার মতে নানা দেশ থেকেও মেধাবী পড়ুয়ারা ভিড় জমান সেখানে। তবে সুযোগ পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। দিতে হত কঠোর পরীক্ষা। একেবারে মূল তোরণে উপস্থিত থাকতেন কোনও না কোনও শিক্ষক। নানা শাস্ত্র থেকে করা কঠিন প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হত। বেশির ভাগই প্রত্যাখ্যাত হতেন। যাঁরা সুযোগ পেতেন, তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল তর্কাতীত। শিক্ষকরাও তেমন। এমনও শোনা যায় আর্যভটের মতো গণিতবিদ ছিলেন এখানকার অধ্যক্ষ। বাসুবন্ধু, ধর্মপাল, নাগার্জুন, পদ্মসম্ভব, হিউয়েন সাংয়ের মতো নামও জড়িয়ে ছিল এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

৪২৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা কুমারগুপ্তের আমলে বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা নির্মাণ করেন এই শিক্ষাকেন্দ্র। বৌদ্ধ ধর্মের গবেষণা, ধর্মচর্চাই ছিল প্রধান। পাশাপাশি পড়ানো হত হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ব্যকরণ, ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞানের আরও বেশ কয়েকটি বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চলত রাজ আনুকূল্যে। মেধা এবং একমাত্র মেধাই ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের চাবিকাঠি। এমনকী রাজপরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও কোনও রকম পক্ষপাতিত্বের সুযোগ ছিল না। পড়ার জন্য কোনও বেতন দিতে হত না পড়ুয়াদের। উলটে ২০০টি গ্রাম থেকে তাদের জন্য আসত দুধ, ঘি, চাল, মাখনের মতো নানা পুষ্টিকর খাদ্য।

Nalanda

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গর্ব ছিল এখানকার পাঠাগার। নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জ’। এখানে ছিল তিনটি অতিকায় বহুতলবিশিষ্ট ভবন। ভবনগুলির নাম ছিল ‘রত্নসাগর’ (যার অর্থ রত্নের মহাসাগর), ‘রত্নোদধি’ (যার অর্থ রত্নের সমুদ্র) ও ‘রত্নরঞ্জক’ (যার অর্থ রত্নখচিত)। সব মিলিয়ে কত বই এখানে ছিল তা জানা না গেলেও লক্ষাধিক বই যে ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত ইতিহাসবিদরা। বলা হয়, উপনিষদের কয়েকটি অংশের আসল পাণ্ডুলিপি ছিল এখানে। ছিল প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র ও গুহ্যসমাজের মতো ধর্মগ্রন্থও। এমন কত! আর সেই সব অমূল্য সম্পদ শেষ পর্যন্ত গিলে খেয়েছিল উন্মত্ত অগ্নি। এবার সেকথায় আসা যাক।

আসলে হানাদারদের প্রকোপে আগেও পড়তে হয়েছে নালন্দা মহাবিহারকে। ৪৫৫ থেকে ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৎকালীন হুন সম্রাট মিহিরকুল হামলা চালালে বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। সেটা সমুদ্রগুপ্তের আমল। তিনি নতুন করে ঢেলে সাজান নালন্দাকে। উলটে আরও বেড়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিধি। এরপর সপ্তম শতাব্দীতে এখানে হামলা চালান বাংলার হানাদার গৌরদাস রাজবংশ। এই আঘাতও সয়ে নিয়েছিল নালন্দা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটশো বছরের প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের কবলে পড়তেই হয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে, যখন তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজির বাহিনী আছড়ে পড়ল অধুনা বিহারের এই অঞ্চলে। রাতারাতি খাঁ খাঁ শ্মশানে পরিণত হয় জ্ঞান ও মেধার এক অনন্ত ভাণ্ডার। কিন্তু কেন?

Nalanda

আসলে উত্তর ভারতে হামলা চালানোর সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন খিলজি। সেই সময় সেখানকার এক রাজা তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও শেষ পর্যন্ত শরীর আর ভাল হচ্ছিল না হানাদার সম্রাটের। বরং উত্তরোত্তর খারাপ হচ্ছিল অবস্থা। এই সময়ই তাঁকে কেউ কেউ উপদেশ দিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ুর্বেদের প্রধান রাহুল শ্রীভদ্রের কাছে যেতে। কিন্তু খিলজির তাতে সায় ছিল না। ভারতের কোনও চিকিৎসক তাঁর স্ত্রী কিংবা প্রভুদের থেকে বেশি যোগ্য, এটা তিনি বিশ্বাসই করতেন না।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য শরীর সারাতে তাঁকে দ্বারস্থ হতেই হয় রাহুলের। কিন্তু সেই সঙ্গে জেদি খিলজি এক অদ্ভুত শর্ত দিয়ে বসলেন। তাঁর শর্ত, তিনি কোনও ওষুধ খাবেন না! এহেন শর্তেও দমলেন না রাহুল। তিনি খিলজিকে কোরানের কয়েকটি পাতা পড়তে দিলেন। আর এতেই যেন ঘটে গেল ম্যাজিক! সেরে উঠলেন খিলজি।

Khilji

আসলে কোরানের ওই কয়েকটি পৃষ্ঠাতে ওষুধ লাগিয়ে রেখেছিলেন রাহুল। অজান্তেই সেই ওষুধ সারিয়ে তুলছিল খিলজিকে। ক্রমে তিনি পুরোপুরি চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। স্বাভাবিক ভাবেই এতে তাঁর রাহুলের উপরে দারুণ খুশি হওয়ার কথা। দেওয়ার কথা পুরস্কার। কিন্তু হল ঠিক উলটো। তুর্কি হানাদার বুঝতে পারলেন, ভারতের চিকিৎসকরা তুরস্কের চিকিৎসকদের থেকে বেশি যোগ্য! ফলে তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়ল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে। ব্যাস! এরপরই তিনি হামলা করলেন মহাবিহারে। আর তারপর…

তারপর কী হল তা ভাবলে আজও শিউরে উঠতে হয়। এত বছরের লব্ধ জ্ঞান, চর্চা, মেধা সব জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল। সেই সঙ্গে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে জীবন্ত অবস্থাতেই পুড়িয়ে মারা হয়। কারও কারও মাথা কেটে ফেলা হয়। যাঁরা বেঁচে যান, তাঁরাও পালিয়ে যান সেখান থেকে। চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যায় নালন্দা।

খিলজির রাগের পিছনে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মিথটিই সত্য, নাকি ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গিয়েছে অন্য কোনও কারণ তা আজ বলা কঠিন। তবে যে কারণই থাক, হানাদারের অক্ষম ক্রোধের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা কেবল ভারতের নয়। বলা যায় সমগ্র এশিয়ার শিক্ষাজগতের কাছেই এই ক্ষতি ছিল অভাবনীয় ও অপূরণীয়। আজও ইতিহাসপ্রেমী মানুষের সংবেদনশীল মন চোখের সামনে দেখতে পায় এক মহান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীর কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ঘৃণার আগুনে! যতবার নালন্দা ধ্বংসের স্মৃতি ফিরে আসে ততবারই যেন লজ্জায় কুঁকড়ে যায়, যেতে থাকে সভ্যতার হৃদয়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement