সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে’- অনুজ কবির থেকে এ পংক্তি ধার নিয়ে বলতেই পারতেন রবীন্দ্রনাথ। বৈশাখের গরমে যেভাবে মালার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়তে হয় তাঁকে, তাতে এ ছাড়া বলার আর কী থাকতে পারে! বাঙালি আবার তাঁর কথাতেই কান পেতে রয়। অগত্যা মালার ভার থেকে রবি ঠাকুরকে মুক্তি দিয়েছে নয়া প্রজন্ম। এবার রবি স্মরণ মিম আর ট্রোলে।
[ জানেন, কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? ]
গতবছর থেকেই চালু হয়েছে এই ট্রেন্ড। মালা-ধূপ, জোড়াসাঁকো, রবীন্দ্রস্মরণের চর্বিতচর্বণের মধ্যে থাকতে নারাজ হাল প্রজন্ম। তারা কী করে? রবি ঠাকুরকে আপন করে তাঁকে নিয়েই মিম বানায়। আর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হওয়া মানেই ভাইরাল। তর্কও কিছু জমে। তবে নেহাতই মোটা দাগের। কেউ বলেন, রবি ঠাকুরকে নিয়ে এসব কী! ছি ছি! পালটা সাফাই দিয়ে আর কেউ বলেন, কেন এতই যদি আপন, তাহলে তাঁকে নিয়ে একটু মশকরা করলেই বাঙালির মহাভারত অশুদ্ধ হবে? কেউ আবার সমসাময়িক ঘটনাকেও জড়িয়ে দেন রবি ঠাকুরের সঙ্গে।
এবছরও সকাল থেকে রবিপক্ষ উদযাপনের চেনা ছবি। রবীন্দ্রসদন ও জোড়াসাঁকোয় চলছে অনুষ্ঠান। পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চ বেঁধে গানে-কবিতায় চলছে রবীন্দ্র স্মরণ। সেই একই সময়ে কী ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায়? দেখা যাচ্ছে, কেউ টোটোর উপর চাপিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। তো কেউ জিনস-টি শার্টে সাজিয়ে তাঁকে ঘুরতে পাঠিয়েছেন। এদিকে গতবারের মতো এবারও পর্নস্টারের সঙ্গে তাঁর ছবি নিয়ে হুলস্থূল। দেখে নেওয়া যাক সেসব নমুনা।
প্রশ্ন হল, এভাবেই কি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মজা-মশকরায় কালযাপন করতে চায় জেন ওয়াই বাঙালি? আসলে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ। কবিস্মরণ করতে গিয়ে এই ক’টাদিন কবিকে নিয়ে যে পরিমাণ মাতামাতি চলে তাতে তিতিবিরক্ত অনেকেই। টার্গেট এখানে কবিগুরু নন। বরং বাঙালির রবি আদিখ্যেতাকেই আক্রমণের ইচ্ছে। এ জিনিস নতুন নয়। বাঙালির এই অতিমাত্রিক রবিপ্রেমকে বরাবারই নানা সময়ে শ্লেষ-কটাক্ষে ভাঙার চেষ্টা হয়েছে, সময়ে সময়ে তার ফর্ম বদলেছে। পাপোশে রবীন্দ্র রচনাবলী ধুলোয় লুটনো থেকে বছরে তিরিশবার শ্যামা-শাপমোচনের অশ্রুমোচন- গান, কবিতার এসব পংক্তিই আমাদের সে ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। যাঁরা এই কথা বলেছিলেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে আত্মস্থ করেছিলেন, কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন নতুন সৃষ্টির দিকে, তাও এই মিম জেনারেশন দেখছে কি? যাঁরা মিম বানাচ্ছেন, তাঁরা কি শোণিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আদৌ নতুন প্রবাহের জন্ম দিচ্ছেন? নাকি অনর্থক আক্রমণেই দায় সারছেন!
এই প্রশ্নের গোলোকধাঁধাতেই আটকে ২৫ বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথকে সত্যিই কি আজ আমাদের ততটা দরকার পড়ছে! রবীন্দ্রনাথ থেকে বাঙালি নিজস্ব প্ররোচনাতেই দূরত্ব বাড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ-ভাবনা থেকে মুখ ফিরিয়েছে। এমনকী ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে যে শিক্ষা, তাও নেওয়ার মানসিকতা তলানিতে। তার নানা সামাজিক কারণ থাকতে পারে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে বলাও যেমন বাতুলতা, তেমনই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মশকরা করাও একই রকম বাহুল্য। দু’টোই সম্ভবত অস্বীকার করে রবীন্দ্র দর্শনকে। মালার বোঝার মতো, মিম-বাঙালিরও অস্বীকার আছে সুতীব্র। একই তীব্রতায় রবীন্দ্রনাথকে পুনরাবিষ্কারের বাসনা আছে তো!
[প্রয়াত ঋত্বিক পত্নী সুরমা ঘটক, শেষকৃত্য কেওড়াতলায়]