সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: একবিংশ শতকেও লিঙ্গ বৈষম্য ঘুচল না। কন্যাসন্তানের জন্ম অনেকের কাছে অপরাধের মতো। এভাবে এসে গেল আরও একটা নারী দিবস। সমাজে নারী-পুরুষের তফাতের মধ্যে নিজেদের মতো করে মাথা উঁচু করে এগোনোর চেষ্টা করছেন অনেকেই। বাংলার নানা প্রান্তে রয়েছে এমন অজস্র সম্ভাবনা। সেই অর্ধেক আকাশের খোঁজে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল। এই সব আং সাং হিরোইনদের নিয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিবেদন ‘তোমারে সেলাম’। চলুন আলাপ করি নগর কলকাতার সেবার প্রতিমূর্তির সঙ্গে।
মা মানেই সেবার প্রতিমূর্তি। কোনও একটা আঙ্গিক থেকে এমন ভাবনা আসা দুর্লভ ব্যাপার নয়। তাই তো হাসপাতালে নার্সিং স্টাফের পেশায় পুরুষদের প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল পাওয়া না গেলেও তাঁর মতো কেউ না কেউ থেকেই যান। আমার আপনার আশপাশে। তাই আহতকে দেখে মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়ার খবরে যেমন চমকে উঠি। তেমনই নাক মুখ দিয়ে আচমকা রক্ত পড়তে থাকা মহিলার মুখে জল ছিটিয়ে সুস্থ করার খবর শান্তি দেয়। কোথাও বেঁচে মানবিকতা, বিবেকবোধ। এই ভরসায় স্বার্থপর দুনিয়ায় কাটিয়ে দেওয়া যায় সামনের দিনগুলি। সেই ভরসাযাগ্য কাঁধটা সঙ্গে থাকা দরকার। যিনি হাত বাড়িয়ে সুস্থতার চাবিকাঠি ছুঁইয়ে দেবেন আপনার পায়ে। পথেঘাটে অসুস্থ হলে তাঁর নামটাই মনে আসবে। তিনি গীতা দে। পেশায় হাসপাতালের নার্স গীতাদেবী। আজ সকলের ডাক্তার দিদি। নিজের সেবাপ্রবণ মন দিয়ে জিতে নিয়েছেন লক্ষ হৃদয়। তাইতো রাতবিরেতেও তিনিই আর্তের সহায়।
কে এই গীতাদেবী? দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী মোড়ের নিত্য যাতায়াতকারীরা তাঁকে এক ডাকে চেনে। চিনতেই হয়। তিনিই তো অন্ধের যষ্ঠীর মতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন না চাইতেই। বিশ্ব নারীদিবসের আগে না হয় তিনিই থাকুন আমাদের হৃদয়ে।
[খবরের ফেরিওয়ালা, সংসারের ছাতা হয়ে একাই ছুটে চলেন ফুলেশ্বরী]
ব্যস্ত রাসবিহারীর রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে মাথাটা ধরেছে মনে হচ্ছে? বেশি চিন্তাভাবনা না করে সোজা পৌঁছে যান গীতাদের কাছে। কলকাতা পুলিশের সাহায্যার্থে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আমার আপনার সেবার জন্য তৈরিই আছেন তিনি। ২০০৩ থেকে এইভাবেই পথচলতি মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ এই মহিলা। কখনও একঘেয়ে লাগে না তাঁর। সকাল ১০টা বাজতেই পৌঁছে যান রাসবিহারীর মোড়ে। দুপুর দুটো পর্যন্ত নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না তাঁর হাতে। কেউ ভিড় বাসে পায়ে চোট পেয়েছেন। ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল। কারওর বা বাসে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল গীতাদেবী ব্লাড প্রেশার মেপে জানিয়ে দিলেন কি কি টেস্ট করাতে হবে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কোন ওষুধটাই বা খেতে হবে। গ্রাম থেকে কোনও কাজে শহর কলকাতায় এসেছিলেন। ফেরার পথে হাঁপাতে হাঁপাতে রাসবিহারীর মোড়েই বসে পড়েছেন। হতক্লান্ত মানুষটির দিকে লেবুজলের গ্লাস বাড়িয়ে দিচ্ছেন সেই গীতা দে। মধ্যবয়সী মহিলার কোনও ক্লান্তি নেই। নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেছেন। সপ্তাহে তিনদিন রাসবিহারীর মোড়ে থাকা ছাড়াও তার কিন্তু আরও কাজ রয়েছে। তিনি একেবারে চলমান পরিষেবা। রাত দুটোতে আপনি চিকিৎসকের ফোন নাও পেতে পারেন। গীতা দেবীকে কিন্তু পাবেন। যখন যেমন সমস্যা আসুক, গীতা দে তৈরি। একবার শুধু তাঁকে ফোন করে আসতে হবে। রাজা বসন্ত রায় রোডে তাঁর বাড়ির সামনে গাড়ি এলেই পৌঁছে যাবেন রোগীর কাছে। সদ্যোজাত হোক বা ৮০ বছরের বৃদ্ধা সকলের জন্যই তিনি হাসি মুখে তৈরি আছেন। কলকাতা পুলিশের সহযোগিতায় এখন ট্রাফিক গার্ডেও থাকছে তাঁর ফার্স্টএইড। এমনিতে রাসবিহারীতে বসলেও তিনি পুলিশের গাড়িতেই জরুরি প্রয়োজনে ছুটে বেড়ান। চলন্ত বাস ট্রামেও সাধ্যমতো চিকিৎসা পরিষেবা দেন। ২০১৫ সালে দেশপ্রিয় পার্কে বড় দুর্গার সময় একটা অঘটন ঘটেছিল। একা হাতেই ক্যাম্প করে তিনি আহতদের সেবা করেছেন। মাত্র একজনকেই প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।
[ফুল বেচে সংসার চালানো, অভাব হারিয়ে সাফল্যের ফুল ফোটাচ্ছে প্রিয়াঙ্কা]
ছবি- অরিজিৎ সাহা