গৌতম ব্রহ্ম: কেউ ছুরি-কাঁচি চালিয়ে রোগীর শরীরে নতুন হার্ট বসান। কেউ বদলে দেন মহাধমনী। কেউ নতুন কিডনি বসিয়ে রোগীকে শাপমুক্ত করেন। কেউ আবার জটিল অপারেশনে চোখে ভরে দেন নতুন আলো। এঁদের স্টেথো গলায় দেখতেই অভ্যস্ত বাংলা। কে জানত, গানের টানে এঁরাই দল বেধে সাধনা শুরু করেছেন? চেম্বার করার পর নিয়ম করে রিহার্সাল দিচ্ছেন?
[বিশ্বকাপের মধ্যেই খারাপ খবর, এশিয়ান গেমসে যাওয়া হচ্ছে না সুনীল ছেত্রীদের]
পাঁচ ডাক্তারবাবুর ব্যান্ড ‘ব্যতিক্রমী’ এখন মঞ্চ মাতাচ্ছে। কর্পোরেট শো থেকে স্বাস্থ্য সেমিনার, সবেতেই ‘অটোম্যাটিক চয়েস’ হয়ে উঠছে পঞ্চপাণ্ডবের এই ব্যান্ড। ভাইরাল হচ্ছে তাদের লাইভ পারফরম্যান্সের ভিডিও। সলিল চৌধুরির ‘সেদিন আর কত দূরে’ থেকে রবিঠাকুরের ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায়’, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘এল বরষা যে’ থেকে শ্যামল মিত্রর ‘তোমারই পথপানে চেয়ে’ স্বর্ণযুগের গান সমবেত কণ্ঠে ফিরিয়ে আনার ব্যতিক্রমী চেষ্টা শুরু করলেন পাঁচ চিকিৎসক। ইউরোলজিস্ট ডা. শিবাজি বসু, কার্ডিয়াক সার্জন ডা. তাপস রায়চৌধুরি, কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান ডা. পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্ডিওলজিস্ট রাজা রায় ও আই সার্জন ডা. বিবেক দত্ত। এমবিবিএস পাস করার পর অনেকেই গানকে পেশা করেছেন। ইউফোরিয়া-র পলাশ সেন, ক্যাকটাসের সিদ্ধার্থ রায়, ‘একলব্য’-র পার্থসারথী ভট্টাচার্য, পল্লব কীর্তনিয়া। কিন্তু ২৪ ক্যারেটের সোনার মতো ডাক্তারদের নিখাদ ব্যান্ড, রাজ্য তো বটেই গোটা বিশ্বে বিরল। তার উপর ব্যতিক্রমী-র সদস্যরা সবাই স্বনামধন্য। দেশ তো বটেই বিদেশেও।
শুরু ২০০৪ সালে। অনুরাধা সাহার মৃত্যুর পর ডাক্তারবাবুদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন এক ডাক্তারবাবু তথা অনুরাধাদেবীর স্বামী ডা. কুণাল সাহা। সেই লড়াইয়ের ‘আপডেট’ প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। জনমানসে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে বিরুদ্ধ ধারণা। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে প্রথম সংগীত পরিবেশন করে ‘ব্যতিক্রমী’। আয়োজকদের উদ্দেশ্য ছিল, এমন কিছু করা যাতে ডাক্তারদের মলিন হওয়া ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকরা দর্শকদের মনে করিয়ে দেন, ডাক্তাররা ভগবান বা কসাই কোনওটাই নন, তাঁরাও রক্তমাংসের মানুষ। কষ্ট পেলে তাঁদের চোখেও জল আসে, রোগীকে বাঁচাতে না পারলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাঁরাও আর পাঁচজনের মতো সময় পেলে গান করেন, কবিতা বলেন।
সেদিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লার মতো বিশিষ্টদের মুগ্ধতা কুড়িয়ে নিয়েছিল তাপসবাবুদের গান। আর এখন তো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়েছে ‘ব্যতিক্রমী’-র এই ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা নিয়ে। তাপসবাবু জানালেন, “অনুষ্ঠান এতটাই হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল যে, বাংলাদেশের ‘টোনাটুনি’ নামে একটি সংস্থা অ্যালবাম তৈরি করায় তাঁদের দিয়ে। ‘খেলা ভাঙার খেলা’ নামে ওই অ্যালবামে বাংলাদেশের ছ’জন চিকিৎসকও গান গেয়েছিলেন।” অ্যালবাম প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকায় গিয়েছিলেন তাপসবাবুরা। গানে গানে মাতিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। ফিরে এসে ব্যান্ড তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। বিবেকবাবু তখন ‘ব্যতিক্রমী’ নামটি দেন। এরপর নীরবেই চলতে থাকে সুর সাধনা। কখনও বিবেকবাবুর কালীঘাটের চেম্বারে, কখনও শিবাজিবাবুর মনোহরপুকুর রোডের বাড়িতে। কখনও আবার তাপসবাবুর গলফ গার্ডেনের ফ্ল্যাটে। পাঁচ গানপাগল ডাক্তার রাত দশটা থেকে রিহার্সাল শুরু করতেন। ঘড়ির কাটা কখন বারোটার ঘর পেরিয়ে যায় খেয়াল থাকে না। কখনও হেমন্ত, কখনও সলিল চৌধুরি, কখনও আবার রবি ঠাকুরের গান। বিবেকবাবু জানালেন, বছরে ১৫-২০ টি অনুষ্ঠান থাকে। মুম্বই, ঝাড়খণ্ডেও গান গাইতে গিয়েছে ‘ব্যতিক্রমী’। তাপসবাবুদের দিয়ে অ্যালবাম করিয়েছে ‘সারেগামা’। সলিল চৌধুরির গান নিয়ে তৈরি সেই অ্যালবাম হট কেকের মতো বিক্রি হয়েছে। সুর মিলিয়ে স্কেল মেপে ট্র্যাকের সঙ্গে গান গাওয়া বেশ কঠিন। মঞ্চে সেই কাজটাই করে ব্যতিক্রমী। ইতিমধ্যেই ৫০ টি ট্র্যাক তৈরি করেছে ‘ব্যতিক্রমী’। তাতেই চলছে অনুষ্ঠান।
গত বছর পয়লা বৈশাখে মুম্বইয়ের দুর্গাবাড়িতেও গান গেয়েছেন তাপসবাবুরা। সম্প্রতি ‘জেআইএস’ নিবেদিত ‘সংবাদ প্রতিদিন চিকিৎসাজ্যোতি সম্মান’-এও সংগীত পরিবেশন করে ব্যতিক্রমী। পরিবেশন করেন ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায়’ ও ‘মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য’। সেই গানের ভিডিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। যেমন ভাইরাল হয়েছিল তাপসবাবুর নেতৃত্বে হওয়া পূর্ব ভারতের প্রথম হার্ট প্রতিস্থাপনের খবর। দিলচঁাদ সিংকে নতুন জীবন দেওয়ার মতোই ডাক্তারি পেশাকে সুরেলা অক্সিজেন দিচ্ছে তাপসবাবুদের ‘ব্যতিক্রমী’। কে জানে, রোগী-ডাক্তারের মধ্যে নড়ে যাওয়া বিশ্বাসের সাঁকোটা হয়তো এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগে মজবুত হবে। আম জনতাকে মনে করিয়ে দেবে, ডাক্তারবাবুরাও রক্তমাংসের মানুষ।
[আফগানিস্তানে ২০ জন শিখকে হত্যা করল আইএস, নিন্দায় সরব ভারত ][
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.