কলহার মুখোপাধ্যায়: স্বঘোষিত ‘পরমব্রহ্ম’ বাবা বীরেন্দ্রদেব দীক্ষিত নিজেকে ঈশ্বরের অংশ বলে দাবি করতেন। তাঁর দাবি, একই দেহে রাম ও শিবের অবস্থান। কোনও মহিলা তাঁর ‘সংস্পর্শে’ এলে দেবী দুর্গার অংশবিশেষ হিসেবে প্রতিপন্ন হবেন। তাই নির্বিচার অধ্যাত্মচর্চায় তাঁর সাধন সঙ্গিনী হলে ব্রহ্ম প্রাপ্তি নিশ্চিত।
সাধন সঙ্গিনী বাছতে তিনি আবার সমাজের নিচুতলা থেকে আসা কমবয়সি মহিলাদের ‘প্রেফার’ করেন। এইরকম ১৫ জন মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে শনিবার। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনকে সরকারি হোমে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা রাজস্থান, বিহার, পাঞ্জাব, হরিয়ানার বাসিন্দা। বাকি ২ জনের বাড়ি হাওড়া জেলায়। তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছে পুলিশ। আধ্যাত্মিক ঈশ্বরীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হানি প্রীত’ চন্দ্রমাতাকে ৮ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
সল্টলেকের যে বাড়িতে ডেরা বেঁধে যৌনাচার ও পাচারের কাজ চলত, সেই সিএল-২৪৯ বাড়িটির মালিকের নাম রবীন্দ্রনাথ দাস। পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। হংকং শিপিং কর্পোরেশন নামে এক সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। বছর বিশেক আগে সেখান থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বীরেন্দ্রদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর বিশ বছর বাদে বোধোদয় হওয়ার পর এখন জানতে পেরেছেন, বাড়িটি হাতিয়ে নেওয়ার ছক কষেছিলেন বীরেন্দ্রদেব। রবীন্দ্রনাথবাবুকে একপ্রকার কেয়ারটেকার করে বাড়িটি দেখভালের কাজে লাগিয়েছিলেন। নিজের বাড়ি হলেও সর্বত্র ঘোরাফেরার অনুমতি ছিল না তাঁর।
বাবা বীরেন্দ্র নিজেকে শিবের ও রামের অংশ বলতেন। সম্প্রতি তিনি নাকি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন। তাঁর দাবি অনুয়ায়ী, তিনি নিজেই এখন শিব। তিনি নিজেই ইশ্বর। তাঁর সান্নিধ্যে এলে ‘মুক্তিস্পর্শ’ পাবেন অন্যান্যরা। ঈশ্বরীয় মার্গে দেবী দুর্গার অংশ হিসাবে প্রতিপন্ন হবেন। নিজের গোপন ঘরে দেবোত্তর হস্তান্তরের কাজ চলত প্রতিরাতে। সেখানে বীরেন্দ্র ব্যতিত অন্য কোনও পুরুষের প্রবেশাধিকার ছিল না।
সেই ঘরটি আপাতত সিল করেছে পুলিশ। সিল করা হয়েছে বাড়িটির বাকি অংশগুলিকেও। রবীন্দ্রনাথবাবু জানিয়েছেন, তিনতলার সেই গোপন ঘরটিতে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি। একদিন দোতলা অবধি উঠেছিলেন। বাবা-র খাস বডিগার্ডের ঘাড় ধাক্কা খেয়ে নেমে আসেন। কী আছে ঘরটিতে? মুখ খোলেনি পুলিশও। তবে পাড়ার লোকজন থেকে পুলিশের নিচুতলা, প্রত্যেকের কৌতুহলের কেন্দ্রে ওই ঘর। তবে এই ঘরটাই শুধু নয়, আড়াইতলায় বেশ কয়েকটি বাঙ্কারও রয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। সেগুলি কী কাজে ব্যবহৃত হত, সে খবর এখনও জানা যায়নি। রবীন্দ্রনাথবাবু জানিয়েছেন সাড়ে পাঁচ কাঠার তিনতলা বাড়িটি জাহাজে চাকরি করার সময় বানিয়েছিলেন ১৯৯৬ সাল নাগাদ। তার পর পরই বীরেন্দ্রদেব আসেন। প্রভাব বিস্তার করে তাঁকে শিষ্য বানান। ‘দখল’ করে নেন বাড়িটি। তারপর থেকে কেয়ারটেকারের কাজ করছেন রবীন্দ্র। বাবার পেয়াদাদের ভয়ে কিছু বলার সাহস পেতেন না।
বিভিন্ন সূত্র মারফত বীরেন্দ্র সম্পর্কে যতটুকু জানা গিয়েছে তা হল, আমেদাবাদ থেকে সংস্কৃতে এম এ পাস করেন এই বাবা। তারপর সৃষ্টির আদি মানব নিয়ে পিএইচডি-র থিসিস জমা দেন। সম্ভবত তা নামাঞ্জুর হয়। তারপর আশ্রম খুলে অধ্যাত্মচর্চায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমে প্রজাপিতা ব্রহ্মকুমারী ঈশ্বরীয় আধ্যাত্মিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত ছিলেন। তারপর আলাদা করে নিজে আধ্যাত্মিক ঈশ্বরীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা করেন। হয়ে ওঠেন সর্বময় কর্তা। এই আশ্রমের বিরুদ্ধে মহিলা পাচার ও বলপূর্বক যৌনাচারের অভিযোগ ওঠে। দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার নেয় সিবিআই। গত ডিসেম্বরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আশ্রমে তল্লাশি চালানো হয়। তার আগেই অবশ্য গা ঢাকা দেন বাবা বীরেন্দ্র। তিনি এখনও নিখোঁজ। তাঁর বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিস জারি করা হয়েছে। তাঁর একদা শিষ্য রবীন্দ্রনাথবাবু বলেছেন, লাদেনকে যদি খুঁজে বের করা যায় তাহলে বাবাকেও খুঁজে পাওয়া যাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.