সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতাল আমরির বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা, অমানবিকতা ও শাসানির অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছে মৃত ঐত্রী দে’র পরিবার। আজ বেলা ১০টায় কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে যাচ্ছেন তাঁরা। মাত্র আড়াই বছরের এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের মা শম্পা দে আজ সকালেও বাড়িতে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা দেখে জ্ঞান হারাচ্ছেন, কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। মৃতার বাবা জয়ন্ত দে অভিযোগ তুলেছেন, আমরির মতো হাসপাতালে প্রয়োজনীয় মেশিন নেই, অস্কিজেন মাস্ক নেই। অথচ, তাঁদের কন্যাসন্তানকে ভরতি করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্তত চারবার টেলিফোন করে প্রয়োজনীয় বিল মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলতে ভোলেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
[অভিযুক্তর পাশে দাঁড়িয়ে ঐত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধেই থানায় আমরি কর্তৃপক্ষ]
মৃত ঐত্রীর মা আজও একই অভিযোগে অনড়। বলছেন, ‘ঘুমের ঘোরে নার্স আমার মেয়েকে ভুল ইনজেকশন দিয়েছে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমার মেয়ে বমি করতে চাইছিল। আমি চিৎকার করে বলি একটা পাত্র দিতে, সিস্টার দিল না। আমি ডাক্তার ডাক্তার করে চিৎকার করছি। কিন্তু ডাক্তার ঘুমোচ্ছে। আমার মেয়ে স্বাস নিতে পারছিল না। আমি নার্সকে বললাম, অক্সিজেন দিন। কিন্তু ওরা কী অক্সিজেন দেবে, স্যাচুরেশন মেশিনই তো নষ্ট। আমার সামনে ডাক্তার এ কথা বলল নার্সকে। আমার মেয়েটা ঠিক সময় অক্সিজেন পেলে বেঁচে যেত।’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ঐত্রীর মা-বাবা তার হার্টের অসুখ লুকিয়ে হাসপাতালে ভরতি করেছিল। কিন্তু ঐত্রীর বাবা আজ মেডিকা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ১২ জুলাই, ২০১৬-র একটি রিপোর্ট দেখিয়ে দাবি করেন, তাঁদের শিশুকন্যার কোনও জটিল হার্টের অসুখ ছিল না। গোটা ঘটনায় যথাযথ তদন্তের দাবি জানিয়ে আজ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছেন মৃতার মা-বাবা। ‘আর কোনও মায়ের কোল যেন খালি না হয়, দিদিকে শুধু এটুকুই বলব।’
[ছেলের পৈতে কে দেবেন? মামলায় ধন্দে স্বয়ং বিচারপতিও]
বুধবার আড়াই বছরের শিশুটির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠল মুকুন্দপুরের আমরি। হাসপাতাল ইউনিট হেড জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায় শিশুটির মা’কে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমার থেকে বড় মস্তান কেউ নেই’। এমন বক্তব্যের পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিশুটির আত্মীয়-স্বজনরা। উত্তেজনা চরমে ওঠে। পরিবারের বক্তব্য, সন্তানহারা মায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র সমবেদনা দেখাননি জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বিরুদ্ধে পূর্ব যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করে মৃত শিশুর পরিবার। চাপে পড়ে কান ধরে ক্ষমা চাইলেও জয়ন্তীর গ্রেপ্তারির দাবিতে সরব পরিবার। আমরির তরফে রাতে জানানো হয়, এই ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছুটিতে পাঠানো হয়েছে জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়কে। নাটক এখানেই শেষ নয়, খানিকক্ষণের মধ্যেই ফের বিবৃতি দিয়ে আমরি কর্তৃপক্ষ জানায়, মৃতার পরিবারের বিরুদ্ধে হাসপাতালের সিইও ও ইউনিট হেডকে শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগে পুলিশে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
[আমার চেয়ে বড় মস্তান আর নেই, আমরি কর্তার শাসানি মৃতার মাকে]
গোটা ঘটনার সূত্রপাত বুধবার সকালে। ঐত্রী দে নামে আড়াই বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয় মুকুন্দপুর আমরিতে। গত রবিবার রাতে জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছিল। গতকাল ভোরে অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। পরিবারের দাবি, তারপরই মেয়ের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। শুরু হয় খিঁচুনি। শ্বাসকষ্ট বাড়লে অক্সিজেন দেওয়ার দরকার পড়ে। কিন্তু, ‘মাস্ক’ খুঁজে না পাওয়ায় তা সময়মতো দেওয়া যায়নি। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হার্ট ফেল করে শিশুটির মৃত্যু হয়। বিচিত্রভানু দাশগুপ্ত নামে আমরির একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সিপিআর দিয়ে ঐত্রীর হার্ট সচল করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সন্তান হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ঐত্রীর বাবা ও মা। শিশুটির বাড়ি সোনারপুর থানার কামালগাজিতে। খবর পেয়ে বহু আত্মীয় পরিজন হাসপাতালে চলে আসেন। শুরু হয় বিক্ষোভ। ঐত্রীর পরিবারের অভিযোগ, ভুল ইনজেকশন দেওয়াতেই এই মৃত্যু। যদিও হাসপাতালের তরফে গ্রুপ সিইও রূপক বড়ুয়া চিকিৎসায় গাফিলতির কথা অস্বীকার করে জানিয়েছেন, “শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে।” শিশুটির ময়নাতদন্তের সুপারিশ করেন আমরির ডাক্তাররা। বিচিত্রভানুর বক্তব্য, “অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনের প্রভাবে হার্ট ফেল হওয়াটা অসম্ভব। সম্ভবত শিশুটির হৃদযন্ত্রে কোনও ত্রুটি বা শরীরে অন্য কোনও অসুস্থতা ছিল। ময়নাতদন্ত হলেই তা পরিষ্কার হবে।”
[লাইনে ফাটল, বিপর্যস্ত শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখার ট্রেন চলাচল]
শিশুটির পরিবারের বিরুদ্ধে পূর্ব যাদবপুর থানায় অভিযোগ করেছে আমরি হাসপাতাল। তাদের অভিযোগ, শিশুটির অসুখ সম্বন্ধে হাসপাতালকে অন্ধকারে রেখে দিয়েছিল পরিবার। আমরির আধিকারিকরা জানিয়েছেন, হাসপাতাল ভাঙচুরের হুমকিও দিয়েছিল ঐত্রীর পরিবার। কিন্তু তিনদিন ভরতি থাকা সত্ত্বেও কেন বাচ্চাটির হৃদযন্ত্রের এই দুর্বলতা জানা গেল না? কোনও সদুত্তর ডাক্তারদের তরফে মেলেনি। ঘটনার পর এদিন পূর্ব যাদবপুর থানায় ঐত্রীর পরিবারের তরফে অভিযোগ দায়ের করা হয়। একটি চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ। অন্যটি জয়ন্তীর বিরুদ্ধে। জয়ন্তীর আচরণের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন ডাক্তাররাও। তাঁদের বক্তব্য, আড়াই বছরের একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিক্ষোভ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মোকাবিলায় ওই আধিকারিক যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা নিন্দনীয়। পুলিশ জানিয়েছে, শিশুটির ময়নাতদন্ত হয়েছে। সিস্টোপ্যাথোলজিকাল পরীক্ষা হওয়ার পর মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যাবে।