শুভঙ্কর বসু: বাবা না মা? সন্তান কার কাছে থাকবে, কে লেখাপড়া শেখাবে, কার সংস্কৃতিতে বড় হবে, এমন নানা বিবাদের ফয়সলার জন্য নানা সময়ে নানা দম্পতি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু ছেলের উপনয়ন দেওয়ার অধিকার কার, এই বিতর্কের জল কোর্টের আঙিনায় গড়াবে কে ভেবেছিল?
তেমনটাই হয়েছে। এমনই এক অদ্ভুত বিবাদের অবসান চেয়ে কলকাতা হাই কোর্টে দুয়ারে কড়া নেড়েছেন কলকাতারই এক দম্পতি। যার দিশা খুঁজতে গিয়ে ধন্ধে পড়ে গিয়েছেন স্বয়ং বিচারপতিও। বিভ্রান্তির কারণ, ‘উপনয়ন’ বা ‘পৈতে’ নিয়ে না আছে কোনও আইন, না হয়েছে কোনও মামলা। তাই বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন চাইছেন, শাস্ত্র পড়ে রীতিমতো তৈরি হয়ে এজলাসে আসতে, যাতে সমস্যার একটা যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য সুরাহা দেওয়া যায়। আজ বৃহস্পতিবার ফের শুনানি হওয়ার কথা।
কিন্তু এক মাত্র ছেলের উপনয়ন! সে তো মহা আনন্দের কথা! তাহলে আদালতে এলেন কেন ওই দম্পতি? জানা যাচ্ছে, বছর পনেরো আগে সল্টলেকের ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখাশোনা করে বিয়ে হয়েছিল নিউটাউনের জয়িতার। ইন্দ্রনীল পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। মোটা মাইনে। ঝাঁ চকচকে জীবনযাত্রা। প্রথমে ছেলে তারপর মেয়ে। সুখের সংসারে ছন্দপতন হল তারপরই যখন ইন্দ্রনীলের চাকরি গেল। জয়িতার অভিযোগ, হতাশায় ভুগতে ভুগতে শেষে অত্যাচার শুরু করেছিলেন স্বামী। কখনও তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছত। এমনকী ছেলে-মেয়েকে বাথরুমে বন্ধ করে মারধরও বাদ যেত না। শেষে সহ্যের সীমা ছাড়ালে ২০১৫-র জুলাইয়ে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে জয়িতা বাপের বাড়ি চলে যান। স্বামীর বিরুদ্ধে ৪৯৮এ ধারায় বধূ নির্যাতনের মামলা ঠোকেন। বছরখানেক বাদে বিধাননগর আদালত নির্দেশ দেয়, খোরপোশ বাবদ ইন্দ্রনীল প্রতি মাসে জয়িতাকে ৩০ হাজার টাকা দেবেন।
সেই ইস্তক এভাবেই চলছে। খাতায়-কলমে বিবাহ বিচ্ছেদ না হলেও ইন্দ্রনীল-জয়িতা আলাদা থাকেন। জয়িতার সঙ্গেই থাকে তাঁর ছেলে-মেয়ে। এখন গোল বেধেছে ছেলের উপনয়ন ঘিরে। কী রকম? জয়িতার কৌঁসুলি উদয়শঙ্কর ভট্টাচার্য ও অনুপম ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ছেলে ক্লাস সেভেনে উঠতেই বাবা ঠিক করে ফেলেছেন, তার পৈতে দিতে হবে। নিজের ইচ্ছের কথা তিনি সন্তানের মায়ের কানেও তুলেছেন। কিন্তু জয়িতা একেবারেই নারাজ। তিনি ছেলের বাবাকে সাফ বলে দিয়েছেন, পৈতের সময় ঢের পড়ে আছে। এবং সময় হলে তিনি নিজেই ছেলের পৈতে দিয়ে দেবেন। শুনে ইন্দ্রনীল স্বভাবতই ক্ষুব্ধ। মীমাংসা চেয়ে তিনি এসেছেন হাই কোর্টে।
বুধবার মামলাটি শুনানির জন্য বিচারপতি ট্যান্ডনের এজলাসে ওঠে। বৃত্তান্ত শুনে বিচারপতি খানিকটা হকচকিয়েই যান। “উপনয়ন হল সম্পূর্ণ ধর্মীয় একটি আচার। এনিয়ে কোনও আইন রয়েছে বলে তো মনে হয় না।” – পর্যবেক্ষণ বিচারপতির। তাঁর কথায়, “মামলাটি শুনতে গেলে আমায় একটু তৈরি হয়ে আসতে হবে।” আজ সেভাবে ‘তৈরি হয়েই’ বিচারপতি এজলাসে আসার কথা। কিন্তু উপনয়ন নিয়ে ভারতীয় ফৌজদারি বা দেওয়ানি বিধিতে কি আদৌ কোনও ফয়সলা হওয়া সম্ভব?
আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, সম্ভব নয়। কেননা উপনয়ন নামক গোটা পর্বটার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে সনাতনী হিন্দুশাস্ত্রের ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজ। বঙ্গীয় পুরোহিত সমাজের কর্তা পণ্ডিত আচার্য গৌতম ত্রিপাঠীর বক্তব্য, “একটি ব্রাহ্মণ শিশুর উপনয়নের সময় পিতা বা মাতা উভয়েরই সমান কর্তব্য ও রীতি পালন করতে হয়। অগ্নিসংস্কার থেকে পুণ্যাহুতি- সবটাই বাবা পালন করবেন মাকে পাশে বসিয়ে। আবার ব্রহ্মচর্য নেওয়ার সময় প্রথম ভিক্ষা গ্রহণ করতে হবে মায়ের হাত থেকে।” বস্তুত পণ্ডিত ত্রিপাঠীর মতে, সনাতনী হিন্দু ধর্মে যে ‘দশ সংস্কার’ পদ্ধতি মেনে ব্রাহ্মণ্যধর্ম পালন করা হয়, তাতে গর্ভধারণ থেকে অন্নপ্রাশন ও উপনয়নপর্ব পর্যন্ত মাতার অধিকার পিতার চেয়ে অধিক। শাস্ত্রজ্ঞদের বিচার তো হাতের কাছেই মজুত। এখন দেখার, আদালত কী বিচার করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.