সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: গুপ্তাতিগুপ্ত ‘শ্রীনাদ’ মন্ত্রোচ্চারনের মাধ্যমে পঞ্চকোট রাজপরিবারে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো। গোপন মন্ত্রে মা ‘শিখরবাসিনী দুর্গা’ পূজিত হন পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারে। দু’হাজার বছরের প্রাচীন এই পুজোর মন্ত্রের লিপি আজও অপ্রকাশিত। এমন কি কাগজ-খাতা-ডায়েরিতেও লিপিবদ্ধ হয়নি ওই মন্ত্র। এমনকী, মা দুর্গার আসনও গুপ্ত! অতীতের সেই রীতি-নীতি মেনে মহালয়ার ছ’দিন আগেই ‘বোধন’-এ পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ল
পঞ্চকোটে।
[ আরও পড়ুন: চাহিদা ভুলে মায়ের চরণ তলে শরণের কথা বলবে কেষ্টপুরের এই পুজো ]
মা ‘শিখরবাসিনী দুর্গা’ এখানে অষ্টধাতুর তৈরি। চতুর্ভুজা, পদ্ম ফুলের ওপর বসে থাকা রাজরাজেশ্বরী মূর্তির দুর্গা ষোল দিন ধরে পুজো পায়। বর্তমানে এই রাজপরিবারের কূলদেবীমাতা রাজরাজেশ্বরীর আলয়ে এই পুজো হয়। সোমবার আর্দ্রা নক্ষত্র যুক্ত কৃষ্ণপক্ষের নবমীর দিন এই পুজো শুরু হল। চলবে মহানবমী পর্যন্ত। ষোল দিনের এই পুজো ষোলকল্পের দুর্গাপুজো নামেও পরিচিত। সোমবার সকালে পুজো শুরু হতেই ঠাকুর দালানে ভিড় করেছিলেন রাজপরিবারের সদস্যরা। যেখানে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চকোট রাজবংশের বংশধর তথা সিপাহী বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা মহারাজাধিরাজ নীলমনি সিং দেও-র প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেও। তাঁর কথায়, “নিত্যপুজোতে মা অধিষ্ঠান করেন তাঁর ঐতিহ্যশালী বেদিতে। মার্বেল পাথরের একটি বড়সিংহাসনের ওপরে রাখা একটি রুপোর সিংহাসনের মাঝে সোনার সিংহাসনের মাথায়। আর মহাসপ্তমীর দিন অর্ধরাত্রি বিহীত পুজোপর্বে থেকে দশমীর পূর্বাহ্ন পর্যন্ত মাকে গুপ্ত আসনে বসানো হয়।” ওই গুপ্ত আসনকে বলা হয় ষোড়ন। এই সময় একটি তলোয়ারও পুজো পায়। যার নাম ‘ভূতনাথ তাগা’।
[ আরও পড়ুন: মাছেই মিল, নাইজেরিয়ার বিখ্যাত মৎস্য উৎসবের ছোঁয়া দুর্গাপুরের এই মণ্ডপে ]
এই পুজোর পরতে-পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। নানা পৌরাণিক আখ্যান। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীর ধার নগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেওর কনিষ্ঠ পুত্র দামোদর শেখর সিং দেও বাহাদুর চাকলা পঞ্চকোটরাজের প্রতিষ্ঠাতা। রাবনবধ করার জন্য শ্রী রামচন্দ্র দুর্গাদেবীর আরাধনার সূচনার্থে যে বোধন করেছিলেন। যা ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। সেই মত অনুসারেই ধারনগরের প্রথা এবং কুলাচারকে মেনে মহারাজা দামোদরশেখর সিং দেও বাহাদুর এই জঙ্গলমহলে দুর্গাপুজো শুরু করেন। দামোদর শেখরের নামানুসারে এই বিস্তীর্ন জঙ্গলমহলের নাম ‘শেখরভূম’ বা ‘শিখরভূম’। তাই এই দুর্গার নামও হয় শিখরবাসিনী দুর্গা। বর্তমানে পঞ্চকোটরাজ দেবোত্তর–র সেবায়েত জগদানন্দ প্রসাদ সিং দেও–র তত্ত্ববধানে এই পুজো হয়। এই রাজবংশের রাজধানী গড়পঞ্চকোট থেকে
শুরু করে পাড়া, কেশরগড়, কাশীপুর যেখানে রাজত্ব স্থানান্তরিত হয়েছে সেখানেই এই পুজো চলছে।
[ আরও পড়ুন: নান্দনিক আলপনায় এবার পুজোয় সেজে উঠবে এস বি পার্ক সর্বজনীনের মণ্ডপ ]
যে বনমালী পণ্ডিতের হাত ধরে এই পুজো হয়। তাদেরই বংশধর বর্তমানে গৌতম চক্রবর্তী এই পুজো করে থাকেন। রাজপরিবারের সদস্যরা বলেন, রাজরাজেশ্বরী দেবী-ই হলেন কল্যানেশ্বরী দেবীর প্রতিমূর্তি। যিনি মাইথনের কাছে সবনপুরে প্রতিষ্ঠিত। এই মা ভূজ্যপত্রে (গাছের ছাল) বা খত (চিঠি)–এ অঙ্গীকার করেন, “আমার প্রতিমূর্তি রাজরাজেশ্বরীর মন্দিরে যতদিন যাবৎ দুর্গাপুজো হবে আমি সেখানে মহাঅষ্টমীর দিন সন্ধিক্ষনে বিশেষরূপে অধিষ্ঠিত হব। এবং প্রমানস্বরূপ দেবী দুর্গার যন্ত্রে সিঁদুরের ওপর পায়ের ছাপ ফেলে আসব।” তাই মহাঅষ্টমীর সন্ধিক্ষনে এই শিখরভূমে মা দুর্গার পায়ের ছাপ দেখা যায়। তাই তো কথিত আছে, “মল্লে রা শিখরে পা/ সাক্ষাৎ দেখবি তো শান্তিপুরে যা….”। দশমীর দিন রাজকূলপুরোহিত পঞ্চকোট রাজপরিবারের মধ্যে এই ‘প্রসাদী সিঁদুর’ বিতরন করেন। যা তাঁরা সারা বছর ব্যবহার করে থাকেন।
ছবি: অমিত সিং দেও৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.