গুলঞ্চলতা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন একজন গ্রামবাসী
গৌতম ব্রহ্ম: কথায় বলে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। এক্ষেত্রে ভিক্ষা পাচ্ছে ঠিকই, তবে নিজের গাঁয়ে নয়। অন্য তল্লাটের মানুষ তাঁর ক্ষমতা উপলব্ধি করে সমাদরে বরণ করছে। অথচ গুণের কদর না করে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছে যোগীর খাসতালুক। আমজনতার নির্লিপ্তি ও অসচেতনতার খেসারত দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ।
হ্যাঁ, গুলঞ্চেরই কথা হচ্ছে। করোনার বাজারে দুর্দম উপকারী এই ভেষজটির জঙ্গল বাংলার মাঠেঘাটে। সেই গুলঞ্চ বা গুড়ুচি চুটিয়ে খাচ্ছে গুজরাত। তাদের জোগান দিতে গিয়ে সাফ হচ্ছে বাংলার জঙ্গল! হতে পারে কাকতালীয়। কিন্তু ঘটনা হল, গুজরাট সরকার কোভিড মোকাবিলায় ২৪৯০ কেজি সংশমনী বটি কেনার পরই বাংলার বহু জঙ্গল থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে বিপুল পরিমাণ গুলঞ্চলতার ঝাড়। জানা যাচ্ছে, লকডউনে আটকে থাকা গ্রামের গরিব ছেলেপুলেদের ময়দানে নামিয়ে একের পর এক জঙ্গল সাফ করছে ফড়েদের দল। রোজ ৪–৫ কুইন্টাল গুলঞ্চলতা (Gulancha tinospora) শুধু বিষ্ণুপুরের জঙ্গল থকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন এই ঘটনা ঘটছে। যা কিনা সামান্য টাকায় কিনে নিচ্ছেন রতনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ত্রিলোচন ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী।
বিষ্ণুপুরের আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা এই ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মত, “ভিন রাজ্যে যদি এভাবে আমাদের ভেষজ চলে যায়, তা হলে প্রয়োজনের সময় আমরা কী করব?” সাধারণ মানুষ বা প্রশাসন কেন নিজের এ হেন দুর্মূল্য সম্পদ রক্ষায় নজর দেবে না? আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, কোভিড মোকাবিলায় সংশমনী বটি বা ট্যাবলেট অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই ট্যাবলেট গুলঞ্চ লতার ক্বাথ থেকেই তৈরি হয়। শ্রীলঙ্কা সরকার ইতিমধ্যে কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে থাকা সন্দেহভাজন ও পজিটিভ রোগীর উপর তা প্রয়োগ করেছে। কেরল, হরিয়ানা, চণ্ডীগড়, জম্মু–কাশ্মীরের মতো রাজ্যে সংশমনী বটি খাওয়ানো হচ্ছে। সম্প্রতি গুজরাটও একাধিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকা প্রায় তিন হাজার রোগীর উপর আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রয়োগ করে। ওষুধে দারুণ কাজ হয়েছে বলে দাবি করে প্রেস কনফারেন্স করেন গুজরাটের আয়ুশ সচিব। এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি আয়ুশ মন্ত্রকের সহযোগিতায় ২৪৯০ কেজি সংশমনী বটি, ১৪৪০ কেজি দশমূল ক্বাথ ও ১০০০ কেজি আয়ুশ ৬৪ ট্যাবলেট কেনে।
রাজ্য সরকারগুলি কোভিড–যুদ্ধে আয়ুর্বেদাস্ত্র ব্যবহার শুরু করতেই গুলঞ্চলতার মতো কাঁচামালের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। ময়দানে নেমে পড়ে ব্যবসায়ী ও ফড়েরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের টাকার লোভ দেখায়। লকডাউনের বাজারে যা উপেক্ষা করা মুশকিল। ফলে, একের পর এক জঙ্গল থেকে সাফ হয়ে যেতে থাকে মহার্ঘ্য হয়ে ওঠা গুলঞ্চলতা। বুধবার ‘সংবাদ প্রতিদিন’–এর তরফে ত্রিলোচনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। গুলঞ্চ লতার কারবারের বিষয়টি তিনি স্বীকার করে নেন। বলেন, ‘‘প্রায় ১৮ বছর যাবৎ তিনি এই ব্যবসা করছেন। রোজ প্রায় ২–৩ টন মাল সংগ্রহ করেন জঙ্গল থেকে। তারপর তা মাঠে ফেলে রোদে শুকিয়ে নেন।” যদিও জানা গিয়েছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের তিনি কেজি প্রতি ৩–৪ টাকা মাত্র দেন। আর ওষুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন কেজি প্রতি ৪০–৫০ টাকা।
কলকাতায় গুরুচির গুড়ো কেজি প্রতি একশো টাকা দিয়ে শুরু। গুরুচি লতা থেকেই তৈরি হয় ‘গিলয় সত্ত্ব’। যার এক কেজির দাম আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। শ্যামবাজারের জে বি রায় কলেজের অধ্যাপক ডা. পুলককান্তি কর জানান, চরক সংহিতায় সূত্রস্থানের ২৫ নম্বর অধ্যায়ে গুরুচির গুণাগুণের উল্লেখ রয়েছে। এটি একটি জেনারালাইজড ইমিউনো মডিউলেটর। বিশেষত জ্বরনাশক। এবং শরীরে জ্বালা–পোড়ায়, রক্ত সংবহনতন্ত্রকে অ্যাক্টিভ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রক্তের তারল্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। পাচন ক্ষমতা বাড়ায়, অরুচি দূর করে। লিভারের রোগ ও ইউরিন–সংক্রমণেও দারুণ কার্যকর। সবচেয়ে বড় কথা, ডায়াবেটিস রোগীরাও এই ওষুধ খেতে পারেন। এই সব গুণের জন্য আয়ুর্বেদে গুরুচিকে অমৃতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনটাই জানালেন পশ্চিমবঙ্গ আয়ুর্বেদ পরিষদের সহ–সভাপতি ডা. প্রদ্যোতবিকাশ কর মহাপাত্র। তাঁর মত, “এভাবে গুরুচির চোরাচালান উদ্বেগজনক। ত্রিলোচনরা কিন্তু বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে আছে।” প্রদ্যোতবাবুর পর্যবেক্ষণ, কোভিডযুদ্ধে গুরুচি ব্রহ্মাস্ত্র হতে পারে। আমাদের রাজ্য সরকারেরও উচিত গুরুচির মতো ভেষজ কোভিড মোকাবিলায় প্রয়োগ করা।”
জানা গিয়েছে, দার্জিলিং জেলা ছাড়া কার্যত বাংলার সব জেলাতেই প্রাকৃতিকভাবে এই ভেষজ জন্মায়। ভারতের কোথাও এই ভেষজের চাষ হয় না। পুরোটাই জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এমনটাই জানিয়েছেন ‘স্টেট মেডিসিনাল প্লান্ট বোর্ড’–এর অধিকর্তা ডা. প্রশান্ত সরকার। তাঁর পর্যবেক্ষণ, নিম, শাল, সেগুন, মহুয়া, পিয়ালের মতো গাছের গা জড়িয়ে এই লতা বেড়ে ওঠে। তবে সবচেয়ে বেশি কদর নিম–গুলঞ্চের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.