ছবি: কৌশিক দত্ত।
ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: লাদাখের হোটেলে, অফিসে নাকি ফ্যান-এসি চালানোর কথা ভাবছে লোকে! লাদাখ কি তবে কলকাতার মতো হয়ে যাবে! ভ্যাপসা গরম নামবে হিমালয়ের কোল ঘেঁষা তিব্বতি ছোট মালভূমিতে! যেমন-তেমন লোকে বললে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যেত কথাটা। কিন্তু বৃহস্পতিবার কলকাতায় বসে কথাগুলো বলে গেলেন সোনম ওয়াংচুক।
লাদাখের নামে সঙ্গে যাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে প্রায় এক দশক। পর্দার সেই ফুংসুক ওয়াংড়ুর শিরদাঁড়া ঠান্ডা করা সতর্কবার্তা, “যে হারে গরম বাড়ছে, তাতে হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা পাহাড়ের হিমবাহ সব গলে যাবে। নতুন করে আর বরফ জমবে না। বৃষ্টি হলে সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ভাসিয়ে সেই জল সরাসরি নিচে নেমে আসবে। আর প্রবল গরমে শুকনো হতে থাকবে এলাকা। গাছেদের সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে যাবে। বুঝতেই পারছেন তারপর কী হবে?” তাঁর সংযোজন, “যদিও এসব না ভেবে আমরা সুখের জীবন-যাপন করছি। তবুও সতর্ক করি আপনাদের, ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি আরও গুরুতর হবে। বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ-সহ পুরো উত্তর ভারতে জলের অভাব হবে। কারণ সেই সব জলের উৎস হিমালয়। শুধু ভারত নয়, এখনই সতর্ক না হলে বাংলাদেশ, মায়ানমার-সহ এশিয়ার একটা বড় অংশের ২০০ কোটি মানুষকে ফল ভুগতে হবে।”
লাদাখ তথা বিশ্বের সার্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন ওয়াংচুকের। গত সেপ্টেম্বর থেকে অনশনে বসে শেষে দিল্লির দরবার অভিযান করেছিলেন। সে সময় আসমুদ্র হিমাচল তাঁর সমর্থনে নানা জায়গায় অনশনে বসেছিল। যে যে শহর-জনপদ সে সময় তাঁর পাশে ছিল, তাদের ধন্যবাদ জানাতে বেরিয়েছেন ওয়াংচুক। সঙ্গে চলছে তাঁর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্যাম্পেন। মহারাষ্ট্র ঘুরে এদিন পৌঁছেছেন কলকাতা।
‘বিপ্লবের শহর’ কলকাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওয়াংচুক বিকেলে হাতজোড় করে মুখ খুললেন কলকাতার সামনে, “নমস্কার, জুলে!” তিব্বতি ভাষায় অভিবাদন জানাতে ‘জুলে’-র ব্যবহার। ওয়াংচুক বললেন, “নমস্কার কলকাতা, নমস্কার বেঙ্গল। লাদাখের হিমবাদ, লাদাখের ফুল, পাখির তরফ থেকে ধন্যবাদ নিয়ে এসেছি।” শীতের এই আছি, এই নেই কলকাত্তাইয়া জলবায়ুর ভিড়ে এ যেন একমুঠো সেই ‘বেহতি হাওয়া’।
মুখে সদা হাসি থাকলেও যার মন ভারি ভবিষ্যতের জলবায়ুর কষ্টের কথা ভেবে। বললেন, “হিমালয়ের পাদদেশ বরাবর যা যা হচ্ছে তার সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়ছে হিমালয়ের গভীরে। সেই শত্রুর নাম ‘ব্ল্যাক কার্বন’। ডিজেলের গাড়ির কালো ধোঁয়া, পর্যটকদের গাড়ির ধোঁয়া, পাহাড়ে নানা সামগ্রী নিয়ে ওঠা ট্রাকের ধোঁয়া থেকে যেগুলো বেরোয়।” ভয়ের কথাগুলো বলতে বলতেই বারবার ওয়াংচুকের মুখ থেকে একমুঠো টাটকা হাওয়ার মতো কিছু শব্দের গুঁড়ো ছিটকে লাগছিল তিব্বতি ভাঙা হিন্দিতে। টানা বলে চলেছেন সোনম, “সেই কার্বন উড়ে গিয়ে হিমবাহের গায় জমতে থাকে। তাতে কালো ছাপ পড়তে থাকে। তাতেই দ্রুত বরফ গলে। হিমবাহ গলে সরাসরি নিচে এসে নামে। বাড়ি ঘর ভেসে যায়। মানুষ ঘরহীন হয়। সেই মানুষকে আমরা ‘গ্লেসিয়ার রিফিউজি’ বলি।”
শীতের মরশুমে এতদূর এসে এমন সব কড়া কড়া কথা বলতে বলতে একবার ওয়াংচুকের মনেও হয়েছিল, তাঁকে হয়তো সকলে উন্নয়ন-বিরোধী ভাবছে। তাই ভাবনা শুধরে দিতে বললেন, “আমি বিকাশের বিরোধী না। তবে বলব একটা সীমা পর্যন্ত বিকাশ হওয়া দরকার। কিন্তু তার পর হলে সেটা বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের যা আছে, সেটা আরও চাই, আরও ভাল চাই, আরও সস্তা চাই। আর তার জন্য সরকার খেটে চলেছে আলাদিনের চিরাগের জিনের মতো। সরকার কী করবে? আমরাই তো ভাল, ভাল জুতো, অনেক সোয়েটার, অনেক বিদ্যুৎ, অনেক বড় বাড়ি-গাড়ি এসব চাই। সরকার তো মানুষেরই হুকুম তামিল করে।”
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যে নদী ভাঙন নিয়ে উদ্বেগের সঙ্গে কেন্দ্রের কাছে দরবারের জন্য উদ্যোগের কথা বলেছেন। যা শুনে ওয়াংচুকের বক্তব্য, “যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে সেই কাজে নজির গড়ে তুলুন মমতাজি।” লাদাখে বসে থেকে নয়, শহরে শহরে ঘুরে এবার মানুষের সঙ্গে মিশে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সতর্ক করে বেড়াচ্ছেন ওয়াংচুক। তারই ফাঁকে শহরবাসীকে তাঁর একটা ছোট্ট টাস্ক, “১০ জন ১০ জন করে সবাইকে বোঝান। তর্ক করুন। খারাপ কিছু হওয়ার আগে পদক্ষেপ নিন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.