রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: নকিং কিংবা ব্যাটিংয়ের মতো ক্রিকেটীয় ক্রিয়াকলাপ ছাড়াও বিগত আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে পূর্বতন কেকেআর অধিনায়ক শ্রেয়স আইয়ার একটা জিনিস মন দিয়ে করে চলেছেন। তা হল, ট্রেনিংয়ের ফাঁকে-ফাঁকে ইডেন গ্যালারির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। আসলে আইপিএল টিমদের প্র্যাকটিস পর্ব থাকলে-টাকলে বেশ কিছু সোৎসাহী ক্রিকেটপিপাসু স্টেডিয়ামের গলি-ঘুঁজি খুঁজে ঠিক ইডেনের ‘বি’ বা ‘এল’ ব্লকের গ্যালারির প্রথম ভাগে জড়ো হয়ে যান। শুক্রবারও দেখছিলাম, অন্তত শ’খানেক ক্রিকেট উপাসক ‘এল’ ব্লকের পদতলে ঘুরঘুর করছেন। শ্রেয়স আইয়ারের সঙ্গে একখানা সেলফি বা অটোগ্রাফ সংগ্রহের অভিলাষে! সে ঠিক আছে, আসুন। শ্রেয়স ভারত খেলেন। ইন্ডিয়া ক্রিকেটার। তাঁকে নিয়ে যে ক্রিকেট জনতার দুর্নিবার মোহ-আকর্ষণ থাকবে, সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ঘরের টিম যারা, যারা বছরের দু’মাস ইডেনে রাজত্ব করে, তাদের জন্য ছিটেফোঁটাও কিছু থাকবে না? কেউ ইডেন ‘বি’ ব্লকের দিকটায় যাবেন না, যেখানে কেকেআর ট্রেনিং করছে?
নাহ্, নেই। কেকেআরের দিকটায় এ দিন কোনও জনমনিষ্যিই নেই! সে স্থান সম্পূর্ণ শুনশান। পুরোদস্তুর খাঁ-খাঁ!
‘পার্পল অ্যান্ড গোল্ড’-কে তৃতীয় আইপিএল ট্রফি দেওয়া প্রাক্তন অধিনায়ক সে সমস্ত খেয়াল করলেন কি না, কে জানে। কিন্তু এ দিন পুনরায় তাঁকে দেখা গেল, উৎসাহী ভিড়ের দিকে দুলকি চালে হাঁটা দিতে! অকাতরে সই বিলোনো চলল। সেলফি তোলা হল। ঈষৎকাল বাদে ইডেনের মাঠকর্মীরা জড়ো হলেন। তাঁদের সঙ্গেও ছবি-টবি তুললেন শ্রেয়স। কেউ আমলই দিচ্ছে না যে, ইডেনে শ্রেয়সের পরিসংখ্যান মোটেও আহামরি নয়। ১২ ইনিংসে রান ২৬৪। ব্যাটিং গড় ২৬.৪। স্ট্রাইক রেট ১২৮। কিন্তু সে সবে পাত্তা দিচ্ছে কে? বরং দেখলে মনে হবে, এ মাঠ যেন শ্রেয়সেরই মাঠ! ইডেন যেন তাঁরই রাজপাট, এ ক্রিকেট-দেবভূমির তিনিই যেন রাজা, তিনিই একচ্ছত্র সম্রাট! উল্টে কেকেআরই যেন অতিথি টিম, শনিবার যারা কি না শ্রেয়সের পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে খেলতে নামছে!
নাইট সমর্থক মাত্রে এ হেন দৃশ্যপট দর্শনে জ্বলুনি হবে। দুঃখ বাড়বে। মুশকিল হল, কিছু করার নেই। এটা সর্বজনবিদিত যে, শ্রেয়স আর কেকেআর সম্পর্কের শেষ অঙ্ক মোটেও সুখের হয়নি। কেকেআর পারত তাদের আইপিএল জয়ী অধিনায়ককে ‘রিটেন’ করতে। করেনি। শ্রেয়সও পারতেন, পাঞ্জাবে গিয়ে কেকেআর নিয়ে পরোক্ষ বিষোদ্গার না করতে। করেননি। যার পরিণাম–এক অনাকাঙ্খিত ‘শৈত্য’ ছেয়ে রয়েছে কেকেআর আর তার পুরনো অধিনায়ককে ঘিরে। এ দিনই শুনলাম যে, মুলানপুরে পাঞ্জাব অবিশ্বাস্য ভাবে ১১১ তুলেও জিতে যাওয়ার পর সে ফ্র্যাঞ্চাইজির লোকজনের উল্লাসনৃত্য ভালো লাগেনি নাইটদের কারও কারও। কিন্তু বলার কিছু ছিল না। করার কিছু ছিল না।
শনিবার জবাবি উত্তর দেওয়া যাবে?
যা বুঝলাম, কেকেআর বিন্দুমাত্র ভাবছে না। ভাবা সম্ভবও নয়। তারা বদলা নয়, বদলের আশায়! কী করা যাবে, আইসিসিইউ বেডে শুয়ে মূমূর্ষ রোগী অলৌকিকের হাত ধরে বেঁচে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখতে পারে শুধু, প্রতিশোধের চিন্তা করে না। অষ্টাদশ আইপিএলে আজ পর্যন্ত আট ম্যাচ খেলে মাত্র তিনটেয় যে জিতেছে কেকেআর। লিগ টেবলে ধুঁকছে সাত নম্বরে। বাকি ছ’টায় পাঁচটা জিততে হবে টিমকে। সঙ্গে দরকার ‘পুষ্টিকর’ নেট রান রেট। নইলে হবে না। কেকেআর নিজেরাও জানে যে, তিনটে টিম ইতিমধ্যে ১২ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে। তিনটে টিম ১০ পয়েন্টে। কেকেআর সেখানে ৬। টিম জিতছে না। ওপেনিং জুটি কিছু করতে পারছে না। ‘কিউরিয়াস কেস অফ আন্দ্রে রাসেল’ কিছুতেই ‘সলভ’ করা যাচ্ছে না। সঙ্গে চলছে অবিরাম ‘রক্তক্ষরণ’। শেষ দু’ম্যাচে কুৎসিত হার নিয়ে।
এ দিন কেকেআরের হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসেছিলেন টিমের বিলিতি অলরাউন্ডার মইন আলি। কোনও রকম ছুতো-নাতা না খুঁজে, অজুহাত না দিয়ে যিনি পরিষ্কার বলে গেলেন, ‘‘পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে চল্লিশ মিনিটের খারাপ ক্রিকেট সমস্ত শেষ করে দিল। যে ভাবে শেষ দু’টো ম্যাচ আমরা খেলেছি, ও ভাবে খেললে চলে না।’’ তবু যা বুঝলাম, এখনও আশা পুরোপুরি ছাড়েননি মইন। বলছিলেন যে, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স থেকে বিশ্বাস-ভরসা নিচ্ছেন তাঁরা। চলতি আইপিএলে হার্দিক পাণ্ডিয়ারাও পরপর হারছিলেন। কিন্তু তার পর আচমকা পরপর জিততে শুরু করেছেন। লিগ টেবলের চার নম্বরে চলে গিয়েছেন। মুম্বই পারলে কলকাতা পারবে না কেন?
পারা অসম্ভব নয়। কিন্তু তার জন্য যে সর্বাগ্রে সঠিক দল নির্বাচন করা প্রয়োজন। ‘রাসেল অন্তর্ধান-রহস্যের’ সমাধান প্রয়োজন! শুনলাম, ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার নাকি ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন যে, তিনি যখন মাঠে নামছেন, আস্কিং রেট ১৪-১৫’তে উঠে যাচ্ছে। আস্কিং রেট দশ থাকলে তিনি আজও খেলা বার করে দেবেন। জিতিয়ে দেবেন কেকেআরকে। কিন্তু একবার চোদ্দো-পনেরো হয়ে গেলে, তা নাকি আন্দ্রে রাসেলেরও সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে!
টিমের খবরাখবরে ফেরা যাক। বিগত বেশ কয়েক দিন ধরেই রভম্যান পাওয়েলকে খেলানোর সর্বাত্মক দাবিদাওয়া উঠছে। কেউ বলছেন, রাসেলকে বসিয়ে রভম্যানকে খেলানো হোক। কেউ আবার বলছেন, একসঙ্গে দু’জনকে খেলালেই বা ক্ষতি কী? এ দিন কেকেআর নেট সেশনে দেখলাম, লুভনীত সিসোদিয়াকে লম্বা সময় ব্যাটিং করিয়ে রাখা হল। যিনি আদতে কিপার-ব্যাটার। সিসোদিয়া খেললে সুবিধে হল, কুইন্টন ডি’কক কিংবা রহমনুল্লাহ গুরবাজের মতো বিদেশি কিপার-ব্যাটার খেলাতে হয় না। অনায়াসে রাসেল-রভম্যান তখন একসঙ্গে খেলতে পারবেন। কিন্তু অত সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে নাইট ম্যানেজমেন্ট? পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তারা পারবে বিদেশি কিপার-ব্যাটার ছাড়া নামতে? কেকেআরের কাউকে কাউকে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত দেখলাম!
বলছি না, পাঞ্জাবকে যতটা জমাট দেখাচ্ছে, যতটা অকুতোভয় লাগছে, ঠিক ততটা ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে কেকেআরকে। মহাচাপের ‘আতলান্তিকে’ সাঁতরে কোন পথ ধরে তারা উপকূলে পৌঁছবে, কিছুতেই ঠাওর করে উঠতে পারছে না। রাতের ইডেন প্রেসবক্সে বসে এ লেখা লিখছি যখন, মাঠে ‘সাউন্ড চেক’ চলছে। প্রবল উদ্যমে ‘করব, লড়ব, জিতব রে’ বাজছে। লিখতে লিখতে যা শুনছি, এবং বড় অদ্ভুত লাগছে। গত বছর এপ্রিলের শেষাশেষি এ সময় কত রোশনাই, আশাবাদের কত শত হাজারবাতিই না জ্বলছিল কেকেআর ঘিরে। ভাবাই যাচ্ছে না, সেখানে এবার এখনই এত শঙ্কা-আতঙ্কের কৃষ্ণবর্ণ আবহ। অথচ পুরো মে মাস পড়ে। এপ্রিলেই হেরে-টেরে গিয়ে প্লে অফ থেকে টিমটা ছিটকে গেলে, বাকি আইপিএল কী নিয়ে বাঁচবেন লক্ষ-লক্ষ নাইট সমর্থকরা?
নাহ্, ঠাকুর-ঠাকুর করে আজকের ম্যাচটা কেকেআর জিতে যাক। আজ বদলা আসুক বদলের হাত ধরে।
দুগ্গা, দুগ্গা!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.