বিশ্বদীপ দে: অতীত বারবার পুনরাবৃত্ত হয়। ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ শুরুর ঠিক আগেই রো-কো জানিয়ে দেন তাঁরা পাঁচদিনের ফরম্যাট থেকে অবসর নেবেন। স্বাভাবিক ভাবেই বিরাট-রোহিতের মতো মহাতারকা সরে যাওয়ায় অধিনায়ক কে হবেন এই প্রশ্ন পাক খেতে থাকে। আর তখনই জানা যায়, এবার ভারতের হয়ে টস করতে যাবেন ২৫ বছরের এক ‘ছোকরা’! তিনি শুভমান গিল। প্রশ্ন ওঠে, যতই প্রতিশ্রুতিবান হোন, এখনও টেস্টে নিজেকে সেভাবে প্রমাণ কি করতে পেরেছেন তিনি? তাহলে কেন তাঁকে দেওয়া হচ্ছে অধিনায়কত্বের মুকুট! আর এই প্রশ্ন থেকেই ফিরে আসতে থাকে তেষট্টি বছর আগের এক সময়। যখন ভারতকে রাতারাতি অধিনায়ক বাছতে হয়েছিল। আর সেই কারণে বেছে নেওয়া হয় এমন একজনকে যাঁর বয়স তখন ২১ বছর! তিনি মনসুর আলি খান পতৌদি। হ্যাঁ, ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ ছিল তাঁরই নামে। আর সেই সিরিজের আগেই ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়ক নির্বাচন ঘিরে শোরগোল এক সরলরেখায় যেন মিলিয়ে দিল দুই যুগের দুই প্রতিনিধিকে। শেষপর্যন্ত অবশ্য ট্রফির নাম থেকে পতৌদিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিতর্ক বেঁধে যাওয়ায় পতৌদি মেডেল ঘোষণা করেছে ইসিবি। মোদ্দা কথা, ২০২৫ সালের জুন এক আশ্চর্য সমাপতনে দু’টি নামকে ভাসিয়ে রাখল ক্রিকেট অলিন্দে। তাঁরা গিল ও পতৌদি। অথচ আজকের জেনারেশনের একটা অংশ নাক সিঁটকে ভাবতেই পারে, হাজার তিনেক রানও যে ব্যাটার করতে পারেননি তাঁকে নিয়ে এত হইচই করার কী আছে। আসলে সব কিছু গুগলে থাকে না। থাকে না নিছক পরিসংখ্যানের খাঁচাতেও। নেভিল কার্ডাস সাহেব সাধে স্কোরবোর্ডকে গালি দিয়েছিলেন! ভারতীয় ক্রিকেটের আদি যুগের এক অন্যতম সুপারস্টারকে চিনতে হলে তাই স্কোরবোর্ডের বাধা সরিয়ে চিনতে হবে।
মনসুর আলি খান পতৌদির স্ত্রী শর্মিলা ও পুত্র সইফ বলিউডের খুব উল্লেখযোগ্য দুই নাম। কন্যা সোহা আলি খান ততটা খ্যাতি না পেলেও রুপোলি পর্দায় প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু তিনি, পতৌদিও যেন বলিউডেরই এক চরিত্র। বলা চলে ‘হিরো’। তাঁকে নিয়ে যে কেন এখনও বায়োপিক হল না কে জানে! বাবা ইফতিকার আলি খানও টেস্ট খেলেছিলেন। তবে ইংল্যান্ডের হয়ে। তাঁর থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজপাটের পাশাপাশি ক্রিকেট দক্ষতাও পেয়েছিলেন মনসুর। সেই মতো কেরিয়ারও এগোচ্ছিল।
কিন্তু আচমকাই এমন এক দুর্ঘটনায় পড়েন, ক্রিকেট খেলাটা হয়তো চিরকালের জন্যই বন্ধ হয়ে যেত অন্য কেউ হলে! তিনি তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনায়ক। সাসেক্সের সঙ্গে খেলা চলাকালীন আচমকাই গাড়িতে করে দোকানে গিয়েছিলেন খেতে। অথচ দোকানটা মাঠ থেকে ৩০০ গজও হবে না। কিন্তু ওইটুকু দূরত্বে গাড়ি চালিয়ে যেতে গিয়েই ঘটে গেল বিপত্তি। আরেকটি গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। কাচ বিঁধে গেল চোখে। চিকিৎসকরা তখনই অস্ত্রোপচার করলেন। এরপর কন্ট্যাক্ট লেন্স পরিয়ে দিলেন চোখে। দৃষ্টি ফিরল ৯০ শতাংশ। স্বাভাবিক জীবনযাপনে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু বাইশ গজে দাঁড়িয়ে দেখলেন বোলারের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া বল একটা নয়, দু’টো! প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। পরে বুঝলেন ভিতরে থাকা বলটাই আসল। সেটাই খেলতে লাগলেন। ভাবলে মনে হতে পারে এমন কী! কিন্তু ওই ভাবে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও খেলে গিয়েছেন। করেছেন শতরান, দ্বিশতরান! তবে পরের দিকে মাথার টুপিটা দিয়ে ঢেকেই রাখতেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ খেলার পর জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। দুর্ঘটনার মাস ছয়েকের মধ্যেই! সেঞ্চুরিও পেলেন। আর সেই সিরিজের পরই গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। কে জানত মাত্র একটা সিরিজে খেলা খেলোয়াড়কে এই সিরিজেই অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নামতে হবে! পরপর দুই টেস্টে ভারত তখন ০-২ পিছিয়ে। ক্যারিবিয়ান দৈত্যদের সামনে করুণ পরিস্থিতি ভারতীয় ক্রিকেট দলের। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় টেস্ট বার্বাডোজে। ফ্র্যাঙ্ক ওরেল (যাঁর স্পোর্টসম্যান স্পিরিট কিংবদন্তি) তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক। তিনি ভারত অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টরকে সতর্ক করেছিলেন একজন বোলারের বিষয়ে। তিনি চার্লি গ্রিফিথ। ২৩ বছরের ওই পেসার এর আগে একটাই টেস্ট খেলেছেন। কিন্তু তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ‘ত্রাস’ হয়ে উঠেছিলেন ততদিনে। শোনা যায়, এক ১৮ বছরের কিশোরের মাথায় বিমার মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সামান্য দুঃখপ্রকাশ পর্যন্ত করেননি। এসব শুনেও অবশ্য নরি কন্ট্রাক্টর পাত্তা দেননি। তার উপর দিলীপ সরদেশাই একটা ওভার খেললেন গ্রিফিথের। এরপরই বিরতি। প্যাভিলিয়নে ফিরতে ফিরতে সরদেশাই ব্যঙ্গের হাসি হেসে অধিনায়ককে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ”ফাস্ট বল না ছাই!” কিন্তু এরপর ফের খেলা শুরু হতেই গ্রিফিথের বল আছড়ে পড়ল কন্ট্রাক্টরের মাথায়। রক্তাক্ত অধিনায়ককে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। তাঁর জায়গায় নামলেন বিজয় মঞ্জরেকর। এবং চোট পেলেন। প্যাভিলিয়নে ফিরে বললেন, ”আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছি।” যদিও পরে তিনি দৃষ্টি ফিরে পেলেন।
এদিকে গ্রিফিথের মুখোমুখি তখন পতৌদি। রান পাননি। কিন্তু বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওই ‘প্রাণঘাতী’ বোলিংয়ের বিরুদ্ধে। সে এক অদ্ভুত সময়। অধিনায়ক আর মাঠে তো বটেই, জীবনেও ফিরতে পারবেন কিনা সন্দেহ (যদিও পরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু ক্রিকেট আর খেলা হয়নি)। এই পরিস্থিতিতে কে হবেন অধিনায়ক, সেই চিন্তা তখন প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে। শেষপর্যন্ত পতৌদিকেই বেছে নেওয়া হল অধিনায়ক হিসেবে। তখন পতৌদির বয়স ২১ বছর ৭৭ দিন (সারা বিশ্বে এত কম বয়সে কেউ টেস্টে অধিনায়কত্ব করেনি তখনও, পরবর্তী সময়ে করেছেন মাত্র দু’জন)। সারা জীবনে খেলা ৪৬টি টেস্টের ৪০টিতেই ছিলেন অধিনায়ক। যার মধ্যে ৯টিতে জিতেছিল দল। এর মধ্যে রয়েছে নিউজিল্যান্ডকে ঘরের মাঠে টেস্টে হারিয়ে মহাদেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জয়ের নজিরও। ব্যাট হাতে করেছেন ডাবল সেঞ্চুরি। এবং কেরিয়ারের একেবারে শেষে আচমকাই ফের দলে ফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুরন্ত ব্যাটিং করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ‘নবাব নবাবি করে’… করেই যায়।
আসলে তাঁর নামের সঙ্গে এই নবাব ছিল আক্ষরিক অর্থেই এক উপাধির মতো। একবার ইয়ান চ্যাপেল তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটের বাইরে কোন পেশায় রয়েছেন। সেই সময় কেবল ক্রিকেট খেলে সংসার নির্বাহ করা যেত না। পতৌদি উত্তরে বলেছিলেন, ”আমি একজন রাজপুত্র।” চ্যাপেল ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। বারবার একই প্রশ্ন করছিলেন। তখন মনসুর আলি খান নাম্নী সেই ডাকাবুকো মানুষটি প্রায় চিৎকার করে বলেছিলেন, ”আরে (ছাপার অযোগ্য)… আমি রাজপুত্র।” হ্যাঁ, তিনি রাজপুত্রই ছিলেন আজীবন। মাথায় পরিহিত টুপির আড়ালে একচোখেই বিশ্বত্রাস বোলারদের পাঠাতেন প্যাভিলিয়নে। ক্রিকেটে তখনও ভারত ‘দুগ্ধপোষ্য’। সেই যুগের ক্রিকেটার হয়ে মাঠে টাইগারের নড়াচড়া, সাফল্য এবং শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে প্রেমকাহিনি তাঁকে করে তুলেছিল অনন্য। সেই রাজকীয়তা এখনও রয়ে গিয়েছে। ট্রফিতে নাম থাকল কি থাকল না তাতে কী এসে যায়!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.