অর্পণ দাস: ফুটবলে প্রচলিত কথা, ক্লাবের থেকে ব্যক্তি বড় নন। কিন্তু ক্লাব ও ব্যক্তি কখনও কখনও মিলেমিশে যান। মোহনবাগানের সঙ্গে স্বপনসাধন বোসের সম্পর্ককে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। ময়দান যাকে চেনে টুটু বোস নামে। সেই ময়দান, যেখানে কোনও কিছু ‘স্থায়ী’ না থাকলেও তাঁর প্রতি সবুজ-মেরুন সমর্থকদের ভালোবাসায় বদল হয়নি। এ যেন বহুজন্মের বন্ধন। অবশেষে তিনদশক পার করে মোহনবাগানে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হল টুটু জমানা (Tutu Bose)। এখন আর তিনি কোনও পদে নেই। কিন্তু সেটা খাতায়-কলমে। সবুজ-মেরুন হৃদয়ে লেখা নাম, চিরদিন অমলিন থেকে যাবে।
আত্মজীবনীর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘মোহনবাগান ক্লাবের জন্য যা করার স-অ-ব করব’। তিনদশকের ইতিবৃত্ত পার করে প্রমাণিত যে টুটুবাবু সব করেছেন, স-অ-ব। মোহনবাগান নিছক কোনও ক্লাব নয়, একটা প্রতিষ্ঠান, একটা আবেগ। দেশ-বিদেশ জুড়ে কোটি-কোটি সভ্য সমর্থক। সবুজ-মেরুনের জয় মানে তাঁদের চোখে-মুখে আনন্দ, ফলাফল বিপক্ষে গেলেই ম্লানমুখ। খেলায় হারজিৎ থাকেই। কিন্তু জয় যেন অভ্যাসের মতো হয়, একটা-দুটো হার আসতেই পারে। কিন্তু পালটা মারের নাম মোহনবাগান। সেই জেদটাকে সবুজ-মেরুন রক্তে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য কঠোর-কঠিন পদক্ষেপ নিতে হয়। তাতে হয়তো সাময়িক আপত্তি আসে, কিন্তু নিজের শর্তে-নিজের ঝুঁকিতে বিশ্বাস বজায় নামার নাম টুটু বোস। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন আগ্রাসন কীভাবে একটা দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারে।
কোথা থেকে শুরু করা যায় সেই কাহিনি? তিনটে দশক তো কম সময় নয়। কত জল বয়ে গিয়েছে গঙ্গায়। রাজনীতি-সমাজ-জীবনযাত্রায় কত পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আজও মোহনবাগান ও টুটু বোস যেন একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। বনস্পতির ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখা এক কিংবদন্তি। বিপদ এসেছে, কুছ পরোয়া নেই- টুটু বোস আছেন। ক্লাব সমস্যায়, কোনও ভয় নেই- টুটু বোস (Tutu Bose) আছেন। ‘মিরাকল’ বলতে ঠিক কী বোঝায়, তার আদর্শ উদাহরণ তিনি। যেন এক জাদুকর- কখন যেন জাদুটুপি থেকে কোন চমক বের করে মুশকিল আসান করবেন, তা তিনি একাই জানেন।
১৯৯১ সালে প্রথমবার তিনি মোহনবাগান ক্লাবের সচিব হন। কাজটা সহজ ছিল না। ধীরেন দে’র মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তির আসনে বসা যে কতটা কঠিন, তা তিনি ভালোমতোই জানতেন। আর সেই আমলে এমন কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন, যা আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হয়। একটা অলিখিত প্রথা ছিল, মোহনবাগান বিদেশি প্লেয়ার সই করায় না। তিনি ঠিক করলেন ‘লোহাকে কাটে লোহা’। অতএব প্রথম বিদেশি হিসেবে সবুজ-মেরুনে এলেন চিমা ওকোরি। প্রথাভাঙা কার্যকলাপ নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি। কিন্তু মানুষটা বোধহয় এরকমই। একদিকে প্রবল জেদ ও অধ্যবসায়, অন্যদিকে মোহনাগানের প্রতি আদিগন্ত ভালোবাসা। দু’য়ের যোগসূত্রের সুফল আজও উপভোগ করছেন সমর্থকরা।
সেই সময় আরও একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ভোট ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে সাধারণ নির্বাচনের মতো করে ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেন। আর তার জন্য কালো কোট পরে প্রধান বিচারপতির সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। ওই একবারই। ১৯৯৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ছিলেন সভাপতি। সচিবের দায়িত্ব তখন বন্ধু অঞ্জন মিত্রর কাঁধে। এই সময়ে মোহনবাগান যে আকস্মিক বিপদে পড়েছিল, তার থেকেও উদ্ধারকর্তার নাম টুটু বোস। ফেডারেশনের সিদ্ধান্তে যে নির্বাসনের মুখে পড়েছিল, সেখান থেকে উদ্ধার করেন তিনি। তার জন্য নিজের পকেট থেকে ২ কোটি টাকা দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। বরং এটা তাঁর কাছে গর্বের যে, দুঃসময়ে ক্লাবের পাশে দাঁড়াতে পেরেছেন। তাই হয়তো জোরগলায় বলতে পারেন, মোহনবাগান ক্লাব আমার সন্তানসম। পরে ২০১৮ থেকে ২০২০-র জানুয়ারি পর্যন্ত ফের সচিব হন। আর ২০২০-২২ ও ২০২২-২০২৫, দুই দফায় ফের ক্লাব সভাপতি।
যে দায়িত্বেই থাকুন না কেন, একটা বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট। দূরদর্শিতা বলতে কী বোঝায়, তার সংজ্ঞা ও উদাহরণ টুটু বোস। বিদেশি প্লেয়ার সই করানোয় যদি সূত্রপাত হয়, তাহলে শেষবেলার কিছু আগে ওস্তাদের মার দেখিয়ে দিয়েছেন। শুধু ক্লাবের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করা নয়, সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের পথকে আরও মসৃণ করার কাজটাও করে দিয়েছেন। ২০২০ সালে আরপিএসজি গ্রুপের কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার মূল কারিগর তো তিনিই। পাশে ছিলেন বর্তমান সচিব সৃঞ্জয় বোস। গত মরশুমে মোহনবাগানের মাথায় দ্বিমুকুট। এশিয়ার মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ। দেশের সেরা প্লেয়াররা সবুজ-মেরুন জার্সিতে খেলার জন্য মুখিয়ে। পেশাদারিত্বের সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনার মিশ্রণ ঘটলে যে সাফল্য আসে, তার ‘অ-আ-ক-খ’ শেখাতে পারেন টুটু বোস।
একইভাবে ইস্টবেঙ্গলের ‘ঘরের ছেলে’দের মোহনবাগানে সই করানো নিয়েও আপত্তির দরজা ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। কৃশানু দে, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তরুণ দে- এঁরা যে সবুজ-মেরুন জার্সি পরতে পারেন, তা কে ভেবেছিল? টুটু বোস সেই অসম্ভবকে সম্ভব করানোর নাম। ময়দানে ফুটবল সই করানো নিয়ে প্রতিযোগিতা নতুন কিছু নয়। আর আজ প্রায় প্রবাদের মতো হয়ে গিয়েছে, ‘মোহনবাগান যে প্লেয়ারকে সই করাবে ভাবে, তাঁকে সই করাবেই’। সেই ট্র্যাডিশন শুরু টুটু জমানায়। আর সেই ট্র্যাডিশন আজও চলিতেছে।
কিন্তু সব কিছুর শেষ হয়, ব্যাটন তুলে দিতে হয় অন্যের হাতে। ‘টাইগার আভি জিন্দা হ্যা’। মোহনবাগানের আনুষ্ঠানিক পদে না থাকলেও ‘টাইগার জিন্দা রহেগা’। ঠিক সময়ে দায়িত্ব ছাড়তে পারাও একটা আর্ট, একটা পারদর্শিতা। সময়ের সঙ্গে মোহনবাগান এগিয়ে যাবে, ঘরে আরও সাফল্য ঢুকবে। যতদিন মোহনবাগান ক্লাব থাকবে, ততদিন টুটু বোসের নাম থাকবে। তিনি সবুজ-মেরুনের প্রাণপুরুষ, প্রধান পূজারী। যে ঐতিহ্য তাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল, শতবর্ষ পার করে যুগের পর যুগ কেটে গেলেও তা অমলিন থাকবে। পদে না থাকলেও তিনি বোস ‘দ্য বোস’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.